সিলেট নগরীতে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা। মাঝে মধ্যে দুয়েকজন ছিচকে ছিনতাইকারী আটক হলেও মূলহোতার থেকে যাচ্ছে ধরাছোয়ার বাইরে। মোটা অংকের টাকা দুরে থাক সামান্য টাকা ব্যাংক থেকে তুলতেও অনেকেই ভয় পাচ্ছেন। জনমনে বিরাজ করছে আতংক। মোবাইল ছিনতাই যেন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছিনতাইকারীদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না সিনিয়র সাংবাদিকরাও।
সন্ধ্যারাতে বাসা-বাড়ীর দরজা ভেঙ্গে ঘটছে চুরির ঘটনা। চুরি হচ্ছে মোটরসাইকেল। কেউ কেউ আইনের আশ্রয় নিলেও অধিকাংশই জিডি পর্যন্ত করছেন না। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সাথে বদলে গেছে নগরীর অপরাধীরা। আওয়ামী লীগের দলীয় শেল্টারে অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িতরা ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল। সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দলের নামধারী কতিপয় দুস্কৃতিকারীদের সাথে আতাঁত করে ফের পাড়া মহল্লায় ফিরে এসেছে তারা। ফলে নগরে চুরি ছিনতাই বাড়ছে। কতিপয় দাগী অপরাধীদের ছত্রছায়ায় নগরজুড়ে চুরি-ছিনতাই দিন দিন বাড়ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সোমবার তিন ব্যাংক থেকে ৪২ লাখ টাকা তুলে বাসায় ফিরছিলেন ব্যবসায়ী রুপায়েল আহমদ ও তার ভাই হেলাল আহমদ। বেলা ২টার দিকে শিবগঞ্জ ফরহাদ খাঁ পুলের পাশে তাদের বহনকারী সিএনজি অটোরিকশার গতিরোধ করে টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। গত সোমবার সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ১২নং ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ সালাউদ্দিন মিয়ার কুয়ারপাড়স্থ ইঙ্গুলাল রোড ৫২/২ নাম্বার বাসায় চুরির ঘটনা ঘটে। স্বর্ণালংকার নগদ টাকা ও প্রাইজবন্ডসহ ৪/৫ লক্ষ টাকার মালামাল নিয়ে চোর চক্র।
খবর পেয়ে কোতোয়ালী থানার লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জালাল আহমদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ও থানায় সাধারণ ডায়রি করার পরামর্শ দেন, স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপি নেতা মোঃ সালাউদ্দিন মিয়ার পরিবার এক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলেন সেখান থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তারা সন্ধ্যার পর বাসায় গিয়ে দেখেন ঘরের দরজা ভাঙ্গা। বাসার আলমারিসহ সকল আসবাবপত্র তছনছ করা। খবর পেয়ে লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এই ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় জিডি করেছেন সালাউদ্দিন মিয়া। গত শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুরে নগরীর চৌহাট্টা এলাকা থেকে সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সহ-সভাপতি ও দৈনিক সিলেটের ডাকের প্রধান বার্তা সম্পাদক এনামুল হক জুবেরের এনড্রয়েড মোবাইল ফোনটি চুরি হয়। এঘটনায় তিনি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেছেন। গত সোমবার দুপুরে নগরীর সোনালী ব্যাংক আম্বরখানা করপোরেট শাখা থেকে বিদেশি টাকা এক্সচেঞ্জ করে রিকশায় আখালিয়ার বাসায় ফিরছিলেন এক নারী।
মোটর সাইকেলে কয়েকজন যুবক তাকে অনুসরণ করে। ব্যাংক থেকে কয়েকশ গজ যাওয়ার পর দর্শন দেউড়ি রাস্তার মুখে তারা তার টাকা ছিনতাইর চেষ্টা করে। সিএনজি অটোরিকশার কয়েকজন চালকের সহায়তায় ওই নারী রক্ষা পান। ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে ছাতক উপজেলার কুর্শিগ্রাম থেকে কয়েকজন নগরীর কেওয়াপাড়ার শাহীন আহমদের বাসায় বেড়াতে আসেন। আত্মীয়দের নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগে জানালা দিয়ে বিছানার ওপর থাকা মোবাইল ফোন ও ব্যানিটি ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায় চোর। গত ৪ নভেম্বর ভোরে ঢাকা থেকে সিলেট বাস টার্মিনাল নেমে কিনব্রিজ যাওয়ার সময় ঝাপটা পার্টির কবলে পড়েন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সাজিদুল ইসলাম। তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় দুই যুবক ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে পালিয়ে যায়। এভাবে প্রতিদিনই নগরীর কোথাও না কোথাও ছিনতাই, চুরি ও ঝাপটা পার্টির কবলে পড়ছেন বিভিন্ন পেশার লোকজন।
শুধু তাই নয়, সম্প্রতি পণ্যবাহী ট্রাক ছিনতাই ও ডাকাতির একাধিক ঘটনাও ঘটেছে। এক মাসে সিলেট নগরীতে অর্ধশতাধিক চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে জনমনে। নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছেন নগরবাসী। ঘরে বাইরে তাদের এখন চুরি ও ছিনতাই আতঙ্ক তাড়া করছে। জানা গেছে, নগরীর বন্দরবাজার ও কিনব্রিজ এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাইকারীদের কবলের পর মোবাইল ও টাকা খোয়াচ্ছেন পথচারী। এছাড়া নগরীর কদমতলী বাস টার্মিনাল, উপশহর, শিবগঞ্জ, আম্বরখানা, টিলাগড়, তেররতন, ওসমানী মেডিকেল এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘবদ্ধ চক্র বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। গত ৫ আগস্টের পর কিছুদিন সিলেটের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন থাকলেও ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে নজর দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু এক মাস ধরে একের পর এক চুরি, ছিনতাইসহ ডাকাতির ঘটনা ঘটছে।
এসএমপির তথ্যমতে, নগরীতে গত নভেম্বরে ১৯টি চুরি, ৮ টি ছিনতাই ও একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এর আগের মাস অক্টোবরে একটি ডাকাতি, ৫ টি ছিনতাই ও ১২টি চুরির ঘটনা ঘটে। গত এক মাসে সংঘটিত ঘটনার মধ্যে গত সোমবার ৪২ লাখ টাকা ছিনতাই, সম্প্রতি ট্রাক থেকে রসুন ছিনতাই, টিলাগড় এলাকা থেকে প্রাইভেটকার ছিনতাই ও উপশহর এলাকায় একটি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা ছিনতাইর ঘটনায়ও পৃথক মামলা হয়েছে। একই সময়ে রায়নগর থেকে মোটরসাইকেল চুরি, উপশহরের দুটি বাসা থেকে দুটি আইফোন চুরি, গত সোমবার সোবহানীঘাটে ছিনতাইর শিকার হওয়া ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুস সামাদসহ ভুক্তভোগীরা থানায় পৃথক জিডি করেন।
পুরাতন মেডিকেল কোয়ার্টারের একটি বাসায় ও দক্ষিণ সুরমার মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের বেটুয়ার মুখ গ্রামে সাবেক ইউপি সদস্য ইলাছ মিয়ার বাড়িতে পৃথক ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও মামলা হয়েছে একটি। এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া কর্মকর্তা উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, জনসাধারণকে আশ্বস্ত করা ও নিরাপত্তা দেয়াই পুলিশের কাজ। পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে অপরাধীদের গ্রেফতারও করছে। এরপরও কিছু দুর্ঘটনা ঘটছে। এর সাথে জড়িতদের গ্রেফতারে আমাদের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। ৪২ লাখ টাকার ছিনতাইয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, এই ঘটনার তদন্ত কাজ অনেক দুর এগিয়েছে। খুব শীঘ্রই এর সাথে জড়িতরা গ্রেফতার হবে এবং মূল রহস্য উদঘাটন হবে। চুরি-ছিনতাইয়ের সাথে রাজনৈতিক শেল্টার আছে কিনা বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।