Sylhet ০৯:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নোটিশ ছাড়াই সারা দেশের অনিবন্ধিত ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট

কোনো ধরনের অগ্রিম নোটিশ ছাড়াই সারা দেশের ছোট-বড় অনিবন্ধিত ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশের (আটাব) একটি চিঠির সূত্র ধরে মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে হুমকিতে পড়েছে ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা।

বর্তমানে সারা দেশের ইউনিয়ন থেকে শুরু করে গ্রাম-মহ ল্লার ছোট ছোট কম্পিউটার দোকানে লাখ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে এই ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা চালাচ্ছেন। ৩০ সেপ্টেম্বর জারি হওয়া এ চিঠির বার্তা দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ল্লাখ ল্লাখ ক্ষুদ্র ও ই-কমার্স ব্যবসায়ী দোকানপাট বন্ধ করে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে গ্রামের একটি ছোট্ট কম্পিউটার দোকানে ডকুমেন্ট কম্পোজের পাশাপাশি ফটোকপি, পাসপোর্ট ফর্ম পূরণ, জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি সেবা ও ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবস্থাসহ কমপক্ষে ২০-২৫টি সেবার কাজ চলে। মোবাইল কোর্টের ভয়ে সব সেবা এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মির্জা মুরাদ হাসান বেগ স্বাক্ষরিত চিঠি ৩০ সেপ্টেম্বর জে ল্লা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো হয়। এতে ব ল্লা হয়, দেশব্যাপী ল্লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সির সংখ্যা অনেক। দেশের বড় বড় শহরের আনাচে-কানাচে, ছোট-বড় ভবন, শপিং কমপ্লেক্স, মোবাইল ফোনের দোকান, কম্পিউটার কম্পোজের দোকান, ট্রেডিং অফিসসহ বিভিন্ন নামের দোকান/অফিসে অসাধু, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ট্রাভেল এজেন্সির ল্লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করছে। বিভিন্ন উৎস থেকে এমন ল্লাইসেন্সবিহীন ট্রাভেল এজেন্সির তালিকা তৈরি করেছে আটাব। এসব এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ অবস্থায় ট্রাভেল এজেন্সি (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০২১ মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯-এর তফশিলভুক্ত হওয়ায় এ আইনের আওতায় অনিবন্ধিত ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

সেক্টরের বিশেষজ্ঞ, এয়ার ল্লাইন্স ব্যবসায়ী, ট্যুর ও ডিজিএস অপারেটরসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে বলেছেন, আটাবের একতরফা চিঠির আলোকে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তটি পুরো আকাশ বাণিজ্যে বড় ধরনের ধস নেমেছে। কারও সঙ্গে আ ল্লাপ-আলোচনা না করে এটি একটি তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার এ ব্যবসা হুমকির মুখে পড়বে বলে তারা জানান। তারা আরও বলেন, এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সেক্টরের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন ছিল। ক্ষুদ্র ও ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ল্লাইসেন্স নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া কিংবা নোটিশ দেওয়ার দরকার ছিল। তাছাড়া আটাব এই সেক্টরের একক বা একমাত্র কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। আটাবের পাশাপাশি এয়ার ল্লাইন্স ব্যবসায়ী, ট্যুর অপারেটর, জিডিএস সংস্থা, আয়াটাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান জড়িত। আটাবের কারণে এখন সব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় ধস নামলে এর জন্য কে দায়ী হবে?

খোদ আটাবের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, লাইসেন্স নেওয়ার জন্য একজন ট্রাভেল এজেন্ট ব্যবসায়ীকে কমপক্ষে ৬ মাসের ব্যবসা পরিচালনার অভিজ্ঞতা দেখাতে হবে। সরকারের এ চিঠির কথা শুনে তারাও এখন ব্যবসা বন্ধ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জানা যায়, বর্তমানে আটাবের পরিচালনা পর্যদের অধিকাংশ সদস্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ-সদস্যদের আত্মীয়স্বজন। অনেকে নেপথ্যে মন্ত্রী, সংসদ-সদস্যদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর নতুন সরকার গঠন হলেও তারা এখনো বহাল তবিয়তে। অভিযোগ আছে, তারাই এখন মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেটের যোগসাজশে সারা দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরির জন্য এ ধরনের একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি এটি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কি না, খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সারা দেশে ইন্টারনেট পৌঁছে যাওয়ায় ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রাম-মহ ল্লা. প্রত্যন্ত এ ল্লাকা পর্যন্ত ছোট ছোট দোকানে, এমনকি যে কোনো মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেই এখন অন ল্লাইনে ট্রাভেল ব্যবসা অর্থাৎ আকাশপথের টিকিট বিক্রির ব্যবসা করছেন। এতে দীর্ঘদিন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যারা একচেটিয়া ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন, তাদের ব্যবসায় ধস নেমেছে। গ্রামের মানুষকে এখন বিদেশে যাওয়ার টিকিট কাটা, টিকিট বুকিং, টিকিট কনফার্মসহ ট্রাভেল ও ট্যুর ব্যবসার যাবতীয় কাজের জন্য ঢাকা বা শহরে আসতে হয় না। ঘরে বসে কম্পিউটারের দোকান থেকে সব ধরনের ই-সেবা পেয়ে যাচ্ছেন তারা। একটি কম্পিউটারের দোকানে এখন ট্রাভেল ব্যবসাসহ সব মিলিয়ে কমপক্ষে ২০/২৫টি ই-সেবা পাওয়া যাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খোদ এক জে ল্লা প্রশাসক যুগান্তরকে বলেন, সরকার যখন গ্রাম পর্যায়ে ই-সেবা বিস্তৃত করতে যাচ্ছে সে মুহূর্তে প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ওপর এই মোবাইল কোর্ট চা ল্লানো আ ত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। মন্ত্রণালয়ের উচিত অন্য কোনো পন্থায় সবাইকে নিবন্ধনের আওতায় আনা। তাছাড়া এখন গ্রাম পর্যায়ে অনেক জে ল্লায় পর্যাপ্ত জনবল নেই। আইনশৃঙ্খ ল্লা বাহিনীও পর্যাপ্ত নেই। এই মুহূর্তে এই সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হবে।

বুধবার রাতে এ বিষয়ে কথা ব ল্লার জন্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন দিলে তিনি নাম গোপন রাখার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। গ্রাম-গঞ্জে যারা ল্লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করছেন তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে না গিয়ে বরং আগে তাদেরকে নিবন্ধনের আওতায় আনার জন্য চিঠি দিতে হবে। সময় বেঁধে দিতে হবে। এজন্য প্রচারণা চা ল্লাতে হবে। তাছাড়া যারা মফস্বলে এ ব্যবসা করছেন তাদের পেছনে নিশ্চয়ই ঢাকার বড় বড় ট্রাভেল এজেন্সির হাত আছে। শহরের ট্রাভেল এজেন্টদের হাত ছাড়া ছোট ব্যবসায়ীদের পক্ষে ব্যবসা করা অসম্ভব। শহরের বড় ব্যবসায়ীদের সবাই আটাবের সদস্য। আগে আটারের সদস্যদের ঠিক করতে হবে তারপর মোবাইল কোর্ট। তবে তিনি বলেন, সব জে ল্লায় এখনো চিঠি পাঠানো হয়নি। আপাতত ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, হবিগঞ্জ, সিলেট ও চাঁদপুরের জে ল্লা প্রশাসকদের চিঠি পাঠানো হয়েছে।

সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার যে আটাবের চিঠির প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে সংগঠনের অনেক প্রভাবশালী সদস্যের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাং ল্লাদেশ এয়ার ল্লাইন্সে ভুয়া টিকিট বুকিং বাতিল করে বছরে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া সংক্রান্ত কারসাজির ফাইল এখনো দুদকে তদন্তাধীন। প্রাথমিকভাবে তদন্তের জন্য ৩ গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (জিডিএস) ও ৫৩ ট্রাভেল এজেন্সির ফাইল দুদকে আছে। এই ৫৩ জনের অধিকাংশ সদস্য আটাবের মেম্বার। চুক্তির মারপ্যাঁচে ফেলে এই খাত থেকে তারা গত ১০ বছরে অবৈধভাবে ১২শ কোটি টাকার বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, এরা সবাই বিমানের টিকিট বুকিং দিয়ে ও পরে সে বুকিং বাতিল করে এই টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া খোদ আটাবের পরিচালনা পর্যদের এক শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও গত বছর বিদেশে আদম পাচারের অভিযোগ আছে। ওই কর্মকর্তার ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ১১ জন বাং ল্লাদেশিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু কাতার ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের বিমানবন্দরে আটকে দেয়। এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এয়ার ল্লাইন্স ও ট্রাভেল এজেন্সিকে জনপ্রতি ৫ হাজার ড ল্লার জরিমানা করার অভিযোগ আছে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ট্রাভেল এজেন্সিকে অব্যব হৃ ত টিকিটের বাকি টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি। অভিযোগ আছে, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ওই ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও এজেন্সিকে ব্ল্যাকলিস্ট করার জন্য কাতার ইমিগ্রেশন পুলিশ থেকে ব ল্লা হলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।

অভিযোগ আছে, আটাব ২০১৯ সালে ‘আটাব অনলাইন লিমিটেড’ নামে একটি টিকিট বিক্রির ফ্ল্যাটফর্ম বা ট্রাভেল এজেন্ট ব্যবসা তৈরি করেছিল। ওই সংগঠনের মাধ্যমে আটাব সারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের শেয়ার বিক্রি করে। সর্বনি ম্ন ১ লাখ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকারও শেয়ার কিনেছেন আটাবের সদস্যরা। কিন্তু সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বেশি দিন এই ব্যবসা চা ল্লাতে পারেনি। ৬ জু ল্লাই তারা এই ব্যবসা বন্ধ করে দেন। অভিযোগ আছে, এই অনলাইন কাছে আটাবের অনেক সদস্য লাখ লাখ টাকা পাওনা রয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধে এই টাকা আ ত্মসাতের অভিযোগ আছে।

সারা দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা প্রসঙ্গে আটাব সভাপতি আব্দুস সা ল্লাম আরেফ বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। এখানে কোনো ষড়যন্ত্র নেই। আওয়ামী লীগ সমর্থিত ট্রাভেল এজেন্সি মালিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা নির্বাচিত হয়েছি।

দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের সদস্যরা অবৈধ এজেন্সিগুলোর একটি তালিকা তৈরি করেছিল। সেটি আমরা মন্ত্রণালয়কে দিয়েছি। বর্তমানে সারা দেশে আমাদের ৪ হাজারের বেশি সদস্য আছেন। তিনি বলেন, অবৈধ ও অনিবন্ধিত ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কারণে আটাবের সদস্যরা ব্যবসা করতে পারছেন না। এরা বৈধ এজেন্সিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেÑঅপরদিকে যাত্রীদের সঙ্গে নানা প্রতারণা ও বিভিন্ন প্যাকেজ, টিকিট ও সেবার নামে টাকা আ ত্মসাৎ করে ল্লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। তারা সরকারকেও কোনো রাজস্ব দিচ্ছে না। তিনি বলেন, যারা বৈধ ব্যবসা করতে চান, তারা আমাদের সদস্যদের সঙ্গে ৬ মাসের ব্যসায়িক সম্পর্ক দেখিয়ে আবেদন করতে পারবেন। আটাব সভাপতি আরও বলেন, আটাবের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে বিমানের টিকিট কেলেঙ্কারি বা টিকিট বুকিং ও বুকিং বাতিল করে ব্যবসা করার নজির নেই। আটাবের কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদম পাচারের অভিযোগ তার জানা নেই।

#দৈনিক যুগান্তর

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Sylhet Vision

নিরীহ কারও নামে মামলা হলে আইনি প্রক্রিয়ায় প্রত্যাহার: আইজিপি

নোটিশ ছাড়াই সারা দেশের অনিবন্ধিত ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট

প্রকাশের সময় : ১২:৪০:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

কোনো ধরনের অগ্রিম নোটিশ ছাড়াই সারা দেশের ছোট-বড় অনিবন্ধিত ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশের (আটাব) একটি চিঠির সূত্র ধরে মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে হুমকিতে পড়েছে ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা।

বর্তমানে সারা দেশের ইউনিয়ন থেকে শুরু করে গ্রাম-মহ ল্লার ছোট ছোট কম্পিউটার দোকানে লাখ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে এই ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা চালাচ্ছেন। ৩০ সেপ্টেম্বর জারি হওয়া এ চিঠির বার্তা দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ল্লাখ ল্লাখ ক্ষুদ্র ও ই-কমার্স ব্যবসায়ী দোকানপাট বন্ধ করে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে গ্রামের একটি ছোট্ট কম্পিউটার দোকানে ডকুমেন্ট কম্পোজের পাশাপাশি ফটোকপি, পাসপোর্ট ফর্ম পূরণ, জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি সেবা ও ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবস্থাসহ কমপক্ষে ২০-২৫টি সেবার কাজ চলে। মোবাইল কোর্টের ভয়ে সব সেবা এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মির্জা মুরাদ হাসান বেগ স্বাক্ষরিত চিঠি ৩০ সেপ্টেম্বর জে ল্লা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো হয়। এতে ব ল্লা হয়, দেশব্যাপী ল্লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সির সংখ্যা অনেক। দেশের বড় বড় শহরের আনাচে-কানাচে, ছোট-বড় ভবন, শপিং কমপ্লেক্স, মোবাইল ফোনের দোকান, কম্পিউটার কম্পোজের দোকান, ট্রেডিং অফিসসহ বিভিন্ন নামের দোকান/অফিসে অসাধু, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ট্রাভেল এজেন্সির ল্লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করছে। বিভিন্ন উৎস থেকে এমন ল্লাইসেন্সবিহীন ট্রাভেল এজেন্সির তালিকা তৈরি করেছে আটাব। এসব এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ অবস্থায় ট্রাভেল এজেন্সি (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০২১ মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯-এর তফশিলভুক্ত হওয়ায় এ আইনের আওতায় অনিবন্ধিত ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

সেক্টরের বিশেষজ্ঞ, এয়ার ল্লাইন্স ব্যবসায়ী, ট্যুর ও ডিজিএস অপারেটরসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে বলেছেন, আটাবের একতরফা চিঠির আলোকে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তটি পুরো আকাশ বাণিজ্যে বড় ধরনের ধস নেমেছে। কারও সঙ্গে আ ল্লাপ-আলোচনা না করে এটি একটি তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার এ ব্যবসা হুমকির মুখে পড়বে বলে তারা জানান। তারা আরও বলেন, এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সেক্টরের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন ছিল। ক্ষুদ্র ও ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ল্লাইসেন্স নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া কিংবা নোটিশ দেওয়ার দরকার ছিল। তাছাড়া আটাব এই সেক্টরের একক বা একমাত্র কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। আটাবের পাশাপাশি এয়ার ল্লাইন্স ব্যবসায়ী, ট্যুর অপারেটর, জিডিএস সংস্থা, আয়াটাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান জড়িত। আটাবের কারণে এখন সব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় ধস নামলে এর জন্য কে দায়ী হবে?

খোদ আটাবের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, লাইসেন্স নেওয়ার জন্য একজন ট্রাভেল এজেন্ট ব্যবসায়ীকে কমপক্ষে ৬ মাসের ব্যবসা পরিচালনার অভিজ্ঞতা দেখাতে হবে। সরকারের এ চিঠির কথা শুনে তারাও এখন ব্যবসা বন্ধ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জানা যায়, বর্তমানে আটাবের পরিচালনা পর্যদের অধিকাংশ সদস্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ-সদস্যদের আত্মীয়স্বজন। অনেকে নেপথ্যে মন্ত্রী, সংসদ-সদস্যদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর নতুন সরকার গঠন হলেও তারা এখনো বহাল তবিয়তে। অভিযোগ আছে, তারাই এখন মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেটের যোগসাজশে সারা দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরির জন্য এ ধরনের একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি এটি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কি না, খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সারা দেশে ইন্টারনেট পৌঁছে যাওয়ায় ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রাম-মহ ল্লা. প্রত্যন্ত এ ল্লাকা পর্যন্ত ছোট ছোট দোকানে, এমনকি যে কোনো মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেই এখন অন ল্লাইনে ট্রাভেল ব্যবসা অর্থাৎ আকাশপথের টিকিট বিক্রির ব্যবসা করছেন। এতে দীর্ঘদিন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যারা একচেটিয়া ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন, তাদের ব্যবসায় ধস নেমেছে। গ্রামের মানুষকে এখন বিদেশে যাওয়ার টিকিট কাটা, টিকিট বুকিং, টিকিট কনফার্মসহ ট্রাভেল ও ট্যুর ব্যবসার যাবতীয় কাজের জন্য ঢাকা বা শহরে আসতে হয় না। ঘরে বসে কম্পিউটারের দোকান থেকে সব ধরনের ই-সেবা পেয়ে যাচ্ছেন তারা। একটি কম্পিউটারের দোকানে এখন ট্রাভেল ব্যবসাসহ সব মিলিয়ে কমপক্ষে ২০/২৫টি ই-সেবা পাওয়া যাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খোদ এক জে ল্লা প্রশাসক যুগান্তরকে বলেন, সরকার যখন গ্রাম পর্যায়ে ই-সেবা বিস্তৃত করতে যাচ্ছে সে মুহূর্তে প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ওপর এই মোবাইল কোর্ট চা ল্লানো আ ত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। মন্ত্রণালয়ের উচিত অন্য কোনো পন্থায় সবাইকে নিবন্ধনের আওতায় আনা। তাছাড়া এখন গ্রাম পর্যায়ে অনেক জে ল্লায় পর্যাপ্ত জনবল নেই। আইনশৃঙ্খ ল্লা বাহিনীও পর্যাপ্ত নেই। এই মুহূর্তে এই সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হবে।

বুধবার রাতে এ বিষয়ে কথা ব ল্লার জন্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন দিলে তিনি নাম গোপন রাখার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। গ্রাম-গঞ্জে যারা ল্লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করছেন তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে না গিয়ে বরং আগে তাদেরকে নিবন্ধনের আওতায় আনার জন্য চিঠি দিতে হবে। সময় বেঁধে দিতে হবে। এজন্য প্রচারণা চা ল্লাতে হবে। তাছাড়া যারা মফস্বলে এ ব্যবসা করছেন তাদের পেছনে নিশ্চয়ই ঢাকার বড় বড় ট্রাভেল এজেন্সির হাত আছে। শহরের ট্রাভেল এজেন্টদের হাত ছাড়া ছোট ব্যবসায়ীদের পক্ষে ব্যবসা করা অসম্ভব। শহরের বড় ব্যবসায়ীদের সবাই আটাবের সদস্য। আগে আটারের সদস্যদের ঠিক করতে হবে তারপর মোবাইল কোর্ট। তবে তিনি বলেন, সব জে ল্লায় এখনো চিঠি পাঠানো হয়নি। আপাতত ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, হবিগঞ্জ, সিলেট ও চাঁদপুরের জে ল্লা প্রশাসকদের চিঠি পাঠানো হয়েছে।

সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার যে আটাবের চিঠির প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে সংগঠনের অনেক প্রভাবশালী সদস্যের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাং ল্লাদেশ এয়ার ল্লাইন্সে ভুয়া টিকিট বুকিং বাতিল করে বছরে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া সংক্রান্ত কারসাজির ফাইল এখনো দুদকে তদন্তাধীন। প্রাথমিকভাবে তদন্তের জন্য ৩ গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (জিডিএস) ও ৫৩ ট্রাভেল এজেন্সির ফাইল দুদকে আছে। এই ৫৩ জনের অধিকাংশ সদস্য আটাবের মেম্বার। চুক্তির মারপ্যাঁচে ফেলে এই খাত থেকে তারা গত ১০ বছরে অবৈধভাবে ১২শ কোটি টাকার বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, এরা সবাই বিমানের টিকিট বুকিং দিয়ে ও পরে সে বুকিং বাতিল করে এই টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া খোদ আটাবের পরিচালনা পর্যদের এক শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও গত বছর বিদেশে আদম পাচারের অভিযোগ আছে। ওই কর্মকর্তার ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ১১ জন বাং ল্লাদেশিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু কাতার ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের বিমানবন্দরে আটকে দেয়। এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এয়ার ল্লাইন্স ও ট্রাভেল এজেন্সিকে জনপ্রতি ৫ হাজার ড ল্লার জরিমানা করার অভিযোগ আছে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ট্রাভেল এজেন্সিকে অব্যব হৃ ত টিকিটের বাকি টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি। অভিযোগ আছে, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ওই ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও এজেন্সিকে ব্ল্যাকলিস্ট করার জন্য কাতার ইমিগ্রেশন পুলিশ থেকে ব ল্লা হলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।

অভিযোগ আছে, আটাব ২০১৯ সালে ‘আটাব অনলাইন লিমিটেড’ নামে একটি টিকিট বিক্রির ফ্ল্যাটফর্ম বা ট্রাভেল এজেন্ট ব্যবসা তৈরি করেছিল। ওই সংগঠনের মাধ্যমে আটাব সারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের শেয়ার বিক্রি করে। সর্বনি ম্ন ১ লাখ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকারও শেয়ার কিনেছেন আটাবের সদস্যরা। কিন্তু সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বেশি দিন এই ব্যবসা চা ল্লাতে পারেনি। ৬ জু ল্লাই তারা এই ব্যবসা বন্ধ করে দেন। অভিযোগ আছে, এই অনলাইন কাছে আটাবের অনেক সদস্য লাখ লাখ টাকা পাওনা রয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধে এই টাকা আ ত্মসাতের অভিযোগ আছে।

সারা দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা প্রসঙ্গে আটাব সভাপতি আব্দুস সা ল্লাম আরেফ বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। এখানে কোনো ষড়যন্ত্র নেই। আওয়ামী লীগ সমর্থিত ট্রাভেল এজেন্সি মালিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা নির্বাচিত হয়েছি।

দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের সদস্যরা অবৈধ এজেন্সিগুলোর একটি তালিকা তৈরি করেছিল। সেটি আমরা মন্ত্রণালয়কে দিয়েছি। বর্তমানে সারা দেশে আমাদের ৪ হাজারের বেশি সদস্য আছেন। তিনি বলেন, অবৈধ ও অনিবন্ধিত ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কারণে আটাবের সদস্যরা ব্যবসা করতে পারছেন না। এরা বৈধ এজেন্সিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেÑঅপরদিকে যাত্রীদের সঙ্গে নানা প্রতারণা ও বিভিন্ন প্যাকেজ, টিকিট ও সেবার নামে টাকা আ ত্মসাৎ করে ল্লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। তারা সরকারকেও কোনো রাজস্ব দিচ্ছে না। তিনি বলেন, যারা বৈধ ব্যবসা করতে চান, তারা আমাদের সদস্যদের সঙ্গে ৬ মাসের ব্যসায়িক সম্পর্ক দেখিয়ে আবেদন করতে পারবেন। আটাব সভাপতি আরও বলেন, আটাবের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে বিমানের টিকিট কেলেঙ্কারি বা টিকিট বুকিং ও বুকিং বাতিল করে ব্যবসা করার নজির নেই। আটাবের কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদম পাচারের অভিযোগ তার জানা নেই।

#দৈনিক যুগান্তর