ঢাকা শহরে তরমুজের কেজি ৭০-৮০ টাকা। রমজানে চাহিদা থাকায় দাম অনেকটা বাড়তি। তবে প্রান্তিক কৃষকের অনেকে জানেনই না, তরমুজ কেজি দরে বিক্রি হয়। তারা পিস হিসেবে বিক্রি করেন। এরপর যতবার তরমুজ হাত বদল হয় ততবারই দাম বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ভোক্তার কাছে এসে ঠেকে কেজিতে। যার দাম কৃষকের কাছে অকল্পনীয়।
উপজেলার কয়েকজন প্রান্তিক তরমুজ চাষির সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। তারা জানিয়েছে, রাজধানী ঢাকাকে তরমুজ কেজিতে বিক্রি হয়—এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তারা শুরু থেকেই তরমুজ পিস হিসেবে বেচা-কেনা করে আসছেন। ঢাকায় তরমুজের কেজি কত সে সম্পর্কে কেউ কেউ সংবাদ মাধ্যম থেকে জানলেও অনেকের অজানা।
তরমুজ চাষিরা জানিয়েছেন, দুইভাবে তরমুজ বিক্রি করেন তারা। প্রথমত ক্ষেত চুক্তি, এতে পুরো ক্ষেতের তরমুজ অনুমান করে একসঙ্গে বিক্রি করে দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের কাছে। এতে মূল চাষির ব্যয়ের সঙ্গে লাভ ধরে দাম নির্ধারণ করে তারা। বিক্রির পর ব্যবসায়ীরা তাদের সময়-সুযোগ অনুযায়ী ক্ষেত থেকে তরমুজ নিয়ে যান। দ্বিতীয়ত, ক্ষেত থেকে তরমুজ কেটে শ হিসেবে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। এ ক্ষেত্রে ওজন ও আকার অনুযায়ী ক্যটাগরি নির্ধারণ করা হয়।
তরমুজ চাষি শাখাওয়াত, সিরাজসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, আনুমানিক পাঁচ কেজি ওজনের একটি তরমুজ তারা ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি করেন। এদিকে ঢাকায় ৮০ টাকা কেজি হলে তরমুজটির দাম হয় ৪০০ টাকা। মধ্যসত্বভোগী ব্যবসায়ীরাই এই লাভ করছেন। প্রান্তিক চাষিরা সামান্য লাভেই তরমুজ বিক্রি করছেন। তাদের দাবি, শহরে দাম এতো বেশি হলে তরমুজের বাজারে বিরুপ প্রতিক্রীয়া হবে। যার প্রভাব পড়বে ক্ষেতের তরমুজে। ভোক্তা তরমুজ কেনা বন্ধ বা কমিয়ে দিলে মাঠে অবিক্রিত তরমুজ নষ্ট হবে বলে ধারণা তাদের। অথবা লসে বিক্রি করতে হবে চাষিদের।
উপজেলার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৭ থেকে ১০ কেজির একটি তরমুজ পিস হিসেবে সর্বোচ্চ ২৭০ টাকা দরে বিক্রি করছেন চাষিরা। আর ছোট তরমুজ (পাঁচ কেজির নিচে) ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে চাষিদের কাছ থেকে কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজিতে কিনছেন ব্যবসায়ীরা।
রাঙ্গাবালী থেকে তরমুজ ট্রলারে নেওয়া হয় গলাচিপা উপজেলায়। এতে প্রতি পিস তরমুজে খরচ হয় পাঁচ টাকা। সেখান থেকে ট্রাকে করে ঢাকায় নেওয়া হয় তরমুজ। আড়ৎদার, ব্যবসায়ী, ট্রাকচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি বড় ট্রাকে বড় সাইজের (৭-১০ কেজি) ২৫০০ পিসের মতো তরমুজ ধরে। আর তরমুজ মাঝারি ও ছোট মিলে তিন থেক সাড়ে তিন হাজার তরমুজ নেওয়া যায়। এতে ট্রাক প্রতি খরচ হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এতে গড়ে তরমুজ প্রতি প্রায় ১০০ টাকা খরচ হয় বলে জানিয়েছেন তারা।
ট্রাকচালক ইমরান শেখ বলেন, ‘আমাদের তেল এবং টোল খরচেই চলে যায় টাকা। এর বাইরেও টুকটাক খরচ আছে। পথে বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে টাকা তোলা হয়। সব মিলিয়ে মালিকের তেমন কিছু থাকে না।’
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এই মৌসুমে রাঙ্গাবালী উপজেলায় ইতোমধ্যে পাঁচ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে তরমুজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সাড়ে আট হাজার হেক্টর জমি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং অনুকূলে পরিবেশ থাকলে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদনের আশা ব্যক্ত করেছিল কৃষি বিভাগ। তবে পোকার আক্রমন এবং রোগের কারণে প্রায় ৩৫ হেক্টরের মত তরমুজের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেক্ষেত্রে উৎপাদন ও আবাদ কম হওয়ায় ৩৫০ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি হবে ধারণা।
উপজেলার কাউখালী এলাকায় প্রায় ১৩ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ করেছেন ছোট বাইশদিয়ার চাষি মিথেল হাওলাদার। শুরুতেই জমি সমস্যায় তার প্রায় ৩ হেক্টর জমির গাছ মরে গেছে। সব সমস্যার পরেও যা ফলন হয়েছে তাতেও লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
মিথেল হাওলাদার বলেন, ‘তরমুজ চাষে কখনও কপাল খোলে কখনও পথে বসতে হয়। তবুও আমরা থেমে থাকি না। এবার উৎপাদন খরচ অনেক বেশি তবুও লাভের আশায় আছি। কিন্তু শুনেছি ঢাকায় তরমুজ কেজি হিসেবে বিক্রি হয়, দামও অনেক। তরমুজকে যদি মানুষের সাধ্যের বাইরে নিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা তবে এর ওপর থেকে ভোক্তা মুখ ফিরিয়ে নেবে। এতে বড় ক্ষতি হবে আমাদের। মাঠের তরমুজ নিয়ে পথে বসতে হবে আমাদের।’
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাঙ্গাবালীতে আসা আড়ৎদার ও তাদের প্রতিনিধিদের দাবি, তারা ঠিক দামে বিক্রি করলেও কারসাজি হয় খুচরা বাজারে। এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না তারা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ২৫-৩০ টন তরমুজ হয়ে থাকে। কৃষকরা তরমুজ পিস হিসাবে বা সমগ্র ক্ষেতের তরমুজ একত্রে বিক্রি করে দেয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতি কেজি তরমুজের দাম ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত সর্বোচ্চ দাম কৃষক পায়। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা পিস হিসেবে ক্রয়কৃত তরমুজ ৮০-১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকে। এর চাপ পড়ে ভোক্তাদের ওপর।