Sylhet ০৩:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

  • পাভেল পার্থ
  • প্রকাশের সময় : ০৯:৩০:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০২৪
  • ৭৮

সিলেট ও সুনামগঞ্জ নদী জলাভূমির দেশ। ১৯০৫ সনে প্রকাশিত আসাম জেলা গেজেটিয়ারে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বহু নদীর নাম আছে। অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির (১৯১০) ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে’ বহু নদীর বিবরণ আছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (২০২৩) সর্বশেষ জরিপে জানাচ্ছে, দেশে সবচেয়ে বেশি নদী আছে সুনামগঞ্জ জেলায়, প্রায় ৯৭টি। কেবল নদী নয়, বৃহত্তর সিলেট জুড়ে লক্ষাধিক ছড়ার অস্তিত্ব ছিল। এত ছড়া, নালা, হাওর ও নদীর মূল কাজ কী? উজান থেকে ভাটিতে পানির প্রাকৃতিক প্রবাহকে অক্ষুন্ন রাখা। এই অঞ্চলের মতো এত বেশি পানির আধার দেশে অন্য কোথাও নেই। তাহলে এমন একটি অঞ্চলে পরপর ভোগান্তির বন্যা হচ্ছে কেন? কোনোভাবেই এটি মৌসুমি বন্যা নয়, ‘জলাবদ্ধ বন্যা’। সিলেট, সুনাগঞ্জ কিংবা বান্দরবানের সাম্প্রতিক জলাবদ্ধ বন্যা পরিস্থিতি বুঝতে হলে ‘বন্যা বিশেষজ্ঞ’ হওয়ার দরকার নাই। বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জারি থাকা প্রবল উন্নয়ন কর্মকা-গুলো বোঝাই যথেষ্ট। পাশাপাশি এই উভয় অঞ্চলের গ্রামীণ নি¤œবর্গ বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখা করছেন তা বোঝা জরুরি। একইসাথে এসব জনভাষ্য আন্দাজে নিতে হবে। স্বীকৃতি দিতে হবে, গ্রহণ করতে হবে। ২০০৬ সাল থেকে যখন পদ্ধতিগতভাবে উল্লিখিত অঞ্চলসমূহে কাজ শুরু করি তখন থেকেই গ্রামীণ নি¤œবর্গের বহু ব্যাখা ও বিশ্লেষণ শুনেছি। প্রাণ ও প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়নকেই বারবার তারা সর্বনাশের মূলে দাঁড় করিয়েছেন। পরিবেশগত ক্ষয়কে নানাভাবে মূল্যায়ন করেছেন। বাংলাদেশে বিদ্যায়তনিক, গণমাধ্যম কিংবা উন্নয়ন পরিসরে সেসব আলোচনা তখনো কেউ শুরু করেননি। প্রায় ২০ বছর ধরে দেখছি প্রবল উন্নয়নচিন্তাগুলি প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়ন প্রসঙ্গকে পাত্তাই দেয়নি। তবে খুব সম্প্রতি বিদ্যায়তনে ও গণমাধ্যমে নিতান্তই স্বল্পপরিসরে পরিবেশগত ক্ষয়ের প্রসঙ্গকে টেনে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যার চল শুরু হয়েছে। যদিও কেউ স্বীকার করছেন না এই বিশ্লেষণ বৃহত্তর সিলেটের গ্রামীণ নি¤œবর্গের। ২০২২ কিংবা ২০২৪ সিলেট ও সুনামগঞ্জের ‘জলাবদ্ধ বন্যার’ জন্য মূলত প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশী উন্নয়ন কর্মকা- দায়ী। নি:সন্দেহে জলবায়ু সংকটের কারণে এককসময়ে হওয়া অতিবর্ষণ এই যন্ত্রণাকে আরো জটিল ও দুঃসহ করে তুলছে। কিন্তু সবকিছু জলবায়ুর ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের অন্যায় উন্নয়ন-বাহাদুরিকে কোনোভাবেই আড়াল করে ফেলা যাবে না। রাষ্ট্র ও কর্তৃপক্ষকে এর ব্যাখা দিতে হবে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা-দুর্গত জীবনের আহাজারি আগলে দাঁড়াতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের রক্তক্ষত সারিয়ে তোলার ভেতর দিয়েই কেবলমাত্র এই জলাবদ্ধ-বন্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব। যে কোনো ধরনের ভুয়া সমাধান ভবিষ্যতের যন্ত্রণা ও জটিলতাকে দুঃসহ করে তুলবে।
চলতি আলাপটিতে আমরা আবারো মনে করিয়ে দিব বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যা ঘটছে, যার নিদারুণ আঘাত তৈরি হচ্ছে সিলেট ও সুনামগঞ্জে। উল্লিখিত অঞ্চল দুটি বৃষ্টিপ্রবণ। উত্তর-পূর্ব ভারতের চেরাপুঞ্জি পৃথিবীর সর্বোচ্চ এবং বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। উভয় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বৃষ্টিকে ধারণ করতে জানে, বৃষ্টির পানি সঞ্চয় ও প্রবাহিত করার বাস্তুতন্ত্র এখানে আছে। কিন্তু উভয় অঞ্চলে আদি প্রাকৃতিকব্যবস্থা গুলি ভেঙেচুরে দখল ও দূষিত করা হয়েছে। অনাবৃষ্টি বা অতিবর্ষণ সবকিছুই এ অঞ্চলের নদী তীরের প্রাণপ্রকৃতি ও জনজীবনকে প্রভাবিত করে। শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে আছে, সুনামগঞ্জে বৃষ্টির পরিমাণ অধিক এবং ১৯০৪ সনে সেখানে প্রায় ২১০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। সুনামগঞ্জে বছরে ২১০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাতের কথা ১৯০৫ সনে প্রকাশিত আসাম জেলা গেজেটিয়ারেও আছে।
বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ ও সিলেট সীমান্তে অবস্থিত উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় কী খাসি ও জৈন্তিয়া পাহাড় ছিল প্রাকৃতিক জঙ্গলে ভরপুর এক বৈচিত্রময় অঞ্চল। বর্ষার ঢল পাহাড়ি বনভূমির ভেতর দিয়ে এক প্রতিবেশীয় স্বরলিপি মেনে গড়িয়ে নামতো হাওর ভাটিতে। হাওরপাড়ের মানুষেরা আন্দাজ করতে পারতেন উজানের পাহাড়ে বৃষ্টি হওয়ার কতসময় বাদে এই ঢল নেমে আসবে ভাটিতে। কিন্তু এখন এসব আন্দাজ করা যাচ্ছে না। মেঘালয় পাহাড় আজ বনশূন্য। বর্তমানে বৃষ্টি হলে তা প্রবাহের কোনো নিয়ম ও গতি না মেনে ছড়া বা নালা দিয়ে প্রবল তোড়ে নামছে হাওর ভাটিতে। তৈরি হচ্ছে পাহাড়ি ঢলের সংকট এবং তলিয়ে যাচ্ছে হাওরের একমাত্র ধানের মওসুম বোরো মৌসুমের ধান। অপরদিকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে পাহাড়ভাঙ্গা বালিতে তলিয়ে যাচ্ছে বসত, কৃষিজমি ও জলাশয়। কুশিয়ারা, সুরমা, বৌলাই, সারি-গোয়াইন, লালাখাল, কালনী, যাদুকাটা, রক্তি যেসব নদী দিয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যাবে সমুদ্রে প্রায় আন্ত:সীমান্ত নদীতেই ভারত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বা বৃহৎবাঁধ নির্মাণ করেছে। একইসাথে বাংলাদেশে সিলেটের বৈশিষ্ট্যময় বাস্তুতন্ত্রকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। পাহাড়-টিলা কেটে সমান করা হয়েছে। বনভূমি বিনাশ। ছড়া, নালা ও হাওর দখল করে ভরাট। পানিপ্রবাহের রাস্তা মানুষ দখল করেছে বলে আজ বৃষ্টির পানি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গড়িয়ে যাওয়ার জায়গা খুঁজছে অনবরত। আটকে থাকা বন্দী পানিপ্রবাহের এই যন্ত্রণা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি না। আমাদের কাছে কেবলমাত্র মানুষের জলাবদ্ধতার কষ্টকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। উজান থেকে ভাটি বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হওয়ার প্রাকৃতিকপথ গুলোকে উন্মুক্ত ও দখলমুক্ত রাখলে সিলেট-সুনামগঞ্জ কোনোভাবেই জলাবদ্ধ হবে না।

২০২২ সালে সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ ভাগ আর সিলেটের ৮০ ভাগ তলিয়ে যায়। বাজার, দোকান, হাসপাতাল, শিক্ষালয় সব বন্ধ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। সিলেটে ১৭ জুন ২০২২ তারিখে ২৮২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, এর আগে ২০০০ সনের ১২ জুন ৩৬২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় এবং ১৯৫৯ সনের ১৯ জুন ৩৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। ২০২২ সনের জুনে তিনদিনে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়েছে ২৪৫৮ মিলিমিটার, যা বাংলাদেশের বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) জানায়, ১৭ জুন ২০২২ তারিখে চেরাপুঞ্জিতে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১৯৯৫ সনের পর জুন মাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। ১৯৯৫ সনের ১৬ জুন চেরাপুঞ্জিতে ১৫৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। একই বছরে ১৫ জুন বৃষ্টি হয়েছিল ৯৩০ মিলিমিটার। ১৯৭৪ সনে ২৭৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। চলতি বছর, ২০২৪ সালের ২৯ মে চেরাপুঞ্জিতে ৬৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। সিলেটের বহু এলাকা একদিনেই তখন প্লাবিত হয়ে যায়। ৯ জুন সিলেটে কয়েক ঘন্টায় বৃষ্টি হয় ২২০ মিলিমিটার। ১৩ জুন ৩৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় চেরাপুঞ্জিতে। ঈদুল আজহার সময়টাতে অবিরাম বৃষ্টি হয় সিলেটে। সিলেটের লালাখালে ৩৩৩, জাফলংয়ে ৩২৭ এবং সুনামগঞ্জের লাউড়ের গড়ে ১৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। একক সময়ে অতিবর্ষণের ফলে ২০২২ সালের মতোই আবারো জলাবদ্ধ-বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয় সিলেট ও সুনামগঞ্জে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একক সময়ে অতিবর্ষণের ফলে স্বল্প সময়ের জন্য পানি জমে থাকে এবং প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয়ে হাওর ও নদীতে মিশে যায়। কিন্তু এখন পানি সরতে পারছে না। পানি আটকে থাকছে। কারণ পানি প্রবাহের সকল পথ ও আধার উন্নয়নের নামে দখল করে রাখা হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের বিন্যাস ও পঞ্জিকা এবং একক সময়ে অতিবর্ষণের মতো প্রবণতা গুলি সম্প্রতি আগের চেয়ে বেড়েছে।
সিলেট-সুনামগঞ্জে ১৭৮৭, ১৮৪২, ১৮৫৮, ১৮৭১, ১৮৭৫, ১৮৮৫, ১৮৯২, ১৯৩১, ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭৪, ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০০, ২০০৪ সালের বন্যার পাশাপাশি বছর বছর পাহাড়ি ঢলে হাওর তলিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু ২০২২ এবং ২০২৪ সালের জলাবদ্ধ বন্যা আমাদের প্রাণ-প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়নের বার্তা দেয়। এই বার্তা পাঠ না করলে সামনে আরো দু:সহ জটিল পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।
লেখক : প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক।

#সুনামগঞ্জের খবর

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Sylhet Vision

জনগণের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছে-তারেক জিয়া

প্রকাশের সময় : ০৯:৩০:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০২৪

সিলেট ও সুনামগঞ্জ নদী জলাভূমির দেশ। ১৯০৫ সনে প্রকাশিত আসাম জেলা গেজেটিয়ারে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বহু নদীর নাম আছে। অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির (১৯১০) ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে’ বহু নদীর বিবরণ আছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (২০২৩) সর্বশেষ জরিপে জানাচ্ছে, দেশে সবচেয়ে বেশি নদী আছে সুনামগঞ্জ জেলায়, প্রায় ৯৭টি। কেবল নদী নয়, বৃহত্তর সিলেট জুড়ে লক্ষাধিক ছড়ার অস্তিত্ব ছিল। এত ছড়া, নালা, হাওর ও নদীর মূল কাজ কী? উজান থেকে ভাটিতে পানির প্রাকৃতিক প্রবাহকে অক্ষুন্ন রাখা। এই অঞ্চলের মতো এত বেশি পানির আধার দেশে অন্য কোথাও নেই। তাহলে এমন একটি অঞ্চলে পরপর ভোগান্তির বন্যা হচ্ছে কেন? কোনোভাবেই এটি মৌসুমি বন্যা নয়, ‘জলাবদ্ধ বন্যা’। সিলেট, সুনাগঞ্জ কিংবা বান্দরবানের সাম্প্রতিক জলাবদ্ধ বন্যা পরিস্থিতি বুঝতে হলে ‘বন্যা বিশেষজ্ঞ’ হওয়ার দরকার নাই। বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জারি থাকা প্রবল উন্নয়ন কর্মকা-গুলো বোঝাই যথেষ্ট। পাশাপাশি এই উভয় অঞ্চলের গ্রামীণ নি¤œবর্গ বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখা করছেন তা বোঝা জরুরি। একইসাথে এসব জনভাষ্য আন্দাজে নিতে হবে। স্বীকৃতি দিতে হবে, গ্রহণ করতে হবে। ২০০৬ সাল থেকে যখন পদ্ধতিগতভাবে উল্লিখিত অঞ্চলসমূহে কাজ শুরু করি তখন থেকেই গ্রামীণ নি¤œবর্গের বহু ব্যাখা ও বিশ্লেষণ শুনেছি। প্রাণ ও প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়নকেই বারবার তারা সর্বনাশের মূলে দাঁড় করিয়েছেন। পরিবেশগত ক্ষয়কে নানাভাবে মূল্যায়ন করেছেন। বাংলাদেশে বিদ্যায়তনিক, গণমাধ্যম কিংবা উন্নয়ন পরিসরে সেসব আলোচনা তখনো কেউ শুরু করেননি। প্রায় ২০ বছর ধরে দেখছি প্রবল উন্নয়নচিন্তাগুলি প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়ন প্রসঙ্গকে পাত্তাই দেয়নি। তবে খুব সম্প্রতি বিদ্যায়তনে ও গণমাধ্যমে নিতান্তই স্বল্পপরিসরে পরিবেশগত ক্ষয়ের প্রসঙ্গকে টেনে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যার চল শুরু হয়েছে। যদিও কেউ স্বীকার করছেন না এই বিশ্লেষণ বৃহত্তর সিলেটের গ্রামীণ নি¤œবর্গের। ২০২২ কিংবা ২০২৪ সিলেট ও সুনামগঞ্জের ‘জলাবদ্ধ বন্যার’ জন্য মূলত প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশী উন্নয়ন কর্মকা- দায়ী। নি:সন্দেহে জলবায়ু সংকটের কারণে এককসময়ে হওয়া অতিবর্ষণ এই যন্ত্রণাকে আরো জটিল ও দুঃসহ করে তুলছে। কিন্তু সবকিছু জলবায়ুর ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের অন্যায় উন্নয়ন-বাহাদুরিকে কোনোভাবেই আড়াল করে ফেলা যাবে না। রাষ্ট্র ও কর্তৃপক্ষকে এর ব্যাখা দিতে হবে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা-দুর্গত জীবনের আহাজারি আগলে দাঁড়াতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের রক্তক্ষত সারিয়ে তোলার ভেতর দিয়েই কেবলমাত্র এই জলাবদ্ধ-বন্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব। যে কোনো ধরনের ভুয়া সমাধান ভবিষ্যতের যন্ত্রণা ও জটিলতাকে দুঃসহ করে তুলবে।
চলতি আলাপটিতে আমরা আবারো মনে করিয়ে দিব বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যা ঘটছে, যার নিদারুণ আঘাত তৈরি হচ্ছে সিলেট ও সুনামগঞ্জে। উল্লিখিত অঞ্চল দুটি বৃষ্টিপ্রবণ। উত্তর-পূর্ব ভারতের চেরাপুঞ্জি পৃথিবীর সর্বোচ্চ এবং বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। উভয় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বৃষ্টিকে ধারণ করতে জানে, বৃষ্টির পানি সঞ্চয় ও প্রবাহিত করার বাস্তুতন্ত্র এখানে আছে। কিন্তু উভয় অঞ্চলে আদি প্রাকৃতিকব্যবস্থা গুলি ভেঙেচুরে দখল ও দূষিত করা হয়েছে। অনাবৃষ্টি বা অতিবর্ষণ সবকিছুই এ অঞ্চলের নদী তীরের প্রাণপ্রকৃতি ও জনজীবনকে প্রভাবিত করে। শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে আছে, সুনামগঞ্জে বৃষ্টির পরিমাণ অধিক এবং ১৯০৪ সনে সেখানে প্রায় ২১০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। সুনামগঞ্জে বছরে ২১০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাতের কথা ১৯০৫ সনে প্রকাশিত আসাম জেলা গেজেটিয়ারেও আছে।
বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ ও সিলেট সীমান্তে অবস্থিত উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় কী খাসি ও জৈন্তিয়া পাহাড় ছিল প্রাকৃতিক জঙ্গলে ভরপুর এক বৈচিত্রময় অঞ্চল। বর্ষার ঢল পাহাড়ি বনভূমির ভেতর দিয়ে এক প্রতিবেশীয় স্বরলিপি মেনে গড়িয়ে নামতো হাওর ভাটিতে। হাওরপাড়ের মানুষেরা আন্দাজ করতে পারতেন উজানের পাহাড়ে বৃষ্টি হওয়ার কতসময় বাদে এই ঢল নেমে আসবে ভাটিতে। কিন্তু এখন এসব আন্দাজ করা যাচ্ছে না। মেঘালয় পাহাড় আজ বনশূন্য। বর্তমানে বৃষ্টি হলে তা প্রবাহের কোনো নিয়ম ও গতি না মেনে ছড়া বা নালা দিয়ে প্রবল তোড়ে নামছে হাওর ভাটিতে। তৈরি হচ্ছে পাহাড়ি ঢলের সংকট এবং তলিয়ে যাচ্ছে হাওরের একমাত্র ধানের মওসুম বোরো মৌসুমের ধান। অপরদিকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে পাহাড়ভাঙ্গা বালিতে তলিয়ে যাচ্ছে বসত, কৃষিজমি ও জলাশয়। কুশিয়ারা, সুরমা, বৌলাই, সারি-গোয়াইন, লালাখাল, কালনী, যাদুকাটা, রক্তি যেসব নদী দিয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যাবে সমুদ্রে প্রায় আন্ত:সীমান্ত নদীতেই ভারত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বা বৃহৎবাঁধ নির্মাণ করেছে। একইসাথে বাংলাদেশে সিলেটের বৈশিষ্ট্যময় বাস্তুতন্ত্রকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। পাহাড়-টিলা কেটে সমান করা হয়েছে। বনভূমি বিনাশ। ছড়া, নালা ও হাওর দখল করে ভরাট। পানিপ্রবাহের রাস্তা মানুষ দখল করেছে বলে আজ বৃষ্টির পানি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গড়িয়ে যাওয়ার জায়গা খুঁজছে অনবরত। আটকে থাকা বন্দী পানিপ্রবাহের এই যন্ত্রণা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি না। আমাদের কাছে কেবলমাত্র মানুষের জলাবদ্ধতার কষ্টকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। উজান থেকে ভাটি বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হওয়ার প্রাকৃতিকপথ গুলোকে উন্মুক্ত ও দখলমুক্ত রাখলে সিলেট-সুনামগঞ্জ কোনোভাবেই জলাবদ্ধ হবে না।

২০২২ সালে সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ ভাগ আর সিলেটের ৮০ ভাগ তলিয়ে যায়। বাজার, দোকান, হাসপাতাল, শিক্ষালয় সব বন্ধ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। সিলেটে ১৭ জুন ২০২২ তারিখে ২৮২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, এর আগে ২০০০ সনের ১২ জুন ৩৬২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় এবং ১৯৫৯ সনের ১৯ জুন ৩৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। ২০২২ সনের জুনে তিনদিনে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়েছে ২৪৫৮ মিলিমিটার, যা বাংলাদেশের বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) জানায়, ১৭ জুন ২০২২ তারিখে চেরাপুঞ্জিতে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১৯৯৫ সনের পর জুন মাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। ১৯৯৫ সনের ১৬ জুন চেরাপুঞ্জিতে ১৫৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। একই বছরে ১৫ জুন বৃষ্টি হয়েছিল ৯৩০ মিলিমিটার। ১৯৭৪ সনে ২৭৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। চলতি বছর, ২০২৪ সালের ২৯ মে চেরাপুঞ্জিতে ৬৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। সিলেটের বহু এলাকা একদিনেই তখন প্লাবিত হয়ে যায়। ৯ জুন সিলেটে কয়েক ঘন্টায় বৃষ্টি হয় ২২০ মিলিমিটার। ১৩ জুন ৩৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় চেরাপুঞ্জিতে। ঈদুল আজহার সময়টাতে অবিরাম বৃষ্টি হয় সিলেটে। সিলেটের লালাখালে ৩৩৩, জাফলংয়ে ৩২৭ এবং সুনামগঞ্জের লাউড়ের গড়ে ১৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। একক সময়ে অতিবর্ষণের ফলে ২০২২ সালের মতোই আবারো জলাবদ্ধ-বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয় সিলেট ও সুনামগঞ্জে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একক সময়ে অতিবর্ষণের ফলে স্বল্প সময়ের জন্য পানি জমে থাকে এবং প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয়ে হাওর ও নদীতে মিশে যায়। কিন্তু এখন পানি সরতে পারছে না। পানি আটকে থাকছে। কারণ পানি প্রবাহের সকল পথ ও আধার উন্নয়নের নামে দখল করে রাখা হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের বিন্যাস ও পঞ্জিকা এবং একক সময়ে অতিবর্ষণের মতো প্রবণতা গুলি সম্প্রতি আগের চেয়ে বেড়েছে।
সিলেট-সুনামগঞ্জে ১৭৮৭, ১৮৪২, ১৮৫৮, ১৮৭১, ১৮৭৫, ১৮৮৫, ১৮৯২, ১৯৩১, ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭৪, ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০০, ২০০৪ সালের বন্যার পাশাপাশি বছর বছর পাহাড়ি ঢলে হাওর তলিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু ২০২২ এবং ২০২৪ সালের জলাবদ্ধ বন্যা আমাদের প্রাণ-প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়নের বার্তা দেয়। এই বার্তা পাঠ না করলে সামনে আরো দু:সহ জটিল পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।
লেখক : প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক।

#সুনামগঞ্জের খবর