ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে সারাদেশে এ পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। উপকূলের জেলাগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে, বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে। ঝড়ে কাঁচা ঘরবাড়ি, দেয়াল ও গাছপালা ভেঙে পড়েছে। অনেক এলাকার রাস্তাঘাট পানির নিচে। অনেক এলাকা বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে।
রবি ও সোমবার পটুয়াখালীতে ৩ জন, ভোলায় ৩ জন, বরিশালে ২ জন, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় একজন করে মোট ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
ঘর চাপা পড়ে মারা যাওয়া মাইশা (৪) দৌলতখান পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের মো. মনির হোসেনের মেয়ে। স্থানীয়রা জানান, রোববার রাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল শিশু মাইশা। ভোরের দিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালে তাদের ঘরের পাশে গাছ ভেঙে পড়ে। এতে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মাইশার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় তাদের পরিবারের আরও তিনজন আহত হয়েছেন।
বোরহানউদ্দিনে গাছচাপায় মারা যান জাহাঙ্গীর। তিনি উপজেলার সাচড়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। সোমবার সকালে সাচড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মহিবুল্লাহ মৃধা জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জাহাঙ্গীর ঝড়ের মধ্যে ঘরের বাইরে বের হয়। এ সময় গাছের ডাল ভেঙে তার গায়ে পড়ে পেটের মধ্যে ঢুকে যায়। এতে সে ঘটনাস্থলেই মারা যান। জাহাঙ্গীর পেশায় একজন কৃষক ছিলেন। পরে তিনি খবর নিহতের বাড়িতে গিয়ে নগদ ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা করেন।
বোরহানউদ্দিন থানার ওসি মো. শাহীন ফকির জানান, ঝড়ে গাছ পড়ে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
লালমোহনের পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যসেবার উদ্যোক্তা মো. আ. হান্নান জানান, রাতের খাবার খেয়ে মনেজা খাতুন ও তার স্বামীসহ ৫-৭ বছর বয়সি ছোট নাতিন নিয়ে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত ৪টার দিকে তীব্র ঝড়ে তাদের বসত ঘরটি বিধ্বস্ত হয়। এ সময় স্বামী আব্দুল কাদের ও ছোট নাতিন বের হতে পারলেও মনেজা খাতুন ঘরের নিচে চাপা পড়েন। পরে পার্শ্ববর্তী লোকজন এসে মনেজা খাতুনকে মৃত উদ্ধার করেন।
লালমোহন থানার ওসি এসএম মাহবুব উল আলম জানান, ঘূর্ণিঝড়ে ঘর চাপা পড়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পেয়েছি। তবে এখনো বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি।
পটুয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মারা গেছেন তিনজন। এর মধ্যে দুমকি উপজেলায় ঝড়ো হাওয়ায় গাছচাপায় জয়নাল হাওলাদার নামে (৭০) এক বৃদ্ধের প্রাণহানি ঘটে। তিনি উপজেলার পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড নলদোয়ানি স্লুইসগেট এলাকার বাসিন্দা।
বাউফলে ঘূর্ণিঝড় রেমালে মৃত্যু হয়েছে মো. আব্দুল করিম (৬০) নামের এক পথচারীর। বেলা ১১টার দিকে উপজেলা পরিষদ গেটের সামনে ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তি উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিহত আব্দুল করিম সামান্য মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ের কোনো এক সময় তিনি উপজেলা পরিষদ গেট সংলগ্ন বিএনপির পুরানো (পরিত্যক্ত) অফিসের নিচে আশ্রয় নেয়। ঝড়ের তাণ্ডবে অফিসটি ভেঙে পড়লে তিনি চাপা পড়ে প্রাণ হারান।
রোববার বিকালে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধূলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে প্লাবিত এলাকা থেকে বোনকে রক্ষা করতে গিয়ে মো. শরীফুল ইসলাম নামে একজনের মৃত্যু হয়।
: রেমালের প্রভাবে ঝড়ো বাতাসে বরিশাল নগরে বহুতল ভবনের ছাদের দেয়ালের অংশ ধসে পাশের টিনশেড খাবার হোটেলের ওপর পড়ে দুজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে লোকমান হোসেন হোটেল মালিক আর মোকছেদুর রহমান কর্মচারী। এছাড়া এ ঘটনায় গুরুতর আহত অপর হোটেল কর্মচারী সাকিবকে উদ্ধার করে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানা পুলিশ।
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আরিচুল হক জানিয়েছেন, সোমবার ভোররাত সাড়ে ৪টার দিকে নগরের রুপাতলী লিলি পেট্রল পাম্পসংলগ্ন এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে।
সোমবার সকালে ঘটনাস্থলে থাকা ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুলতান মাহমুদ বলেন, ছাদের ওপরের দেয়াল বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাসের কারণে ধসে পাশের টিনশেড খাবার হোটেলের ওপর পড়ে। এতে টিনের চালসহ দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে ঘুমন্ত হোটেল মালিকসহ দুই কর্মচারী। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘূর্ণিঝড় রেমাল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করেছে। প্রচণ্ড বেগে বইছে ঝড়ো বাতাস। নদনদীর পানি ৫ থেকে ৭ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে শওকাত মোড়ল (৬৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তিনি গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামের মৃত নরিম মোড়লের ছেলে।
শওকাত মোড়লের পুত্রবধূ আছমা খাতুন জানান, রোববার সন্ধ্যার দিকে তার শ্বশুর শওকাত মোড়ল স্ত্রীকে নিয়ে নাপিতখালী আশ্রয় কেন্দ্রে যাবার পথে রাস্তায় পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কুমিল্লায় বিদ্যালয়ে ক্লাসরত অবস্থায় পার্শ্ববর্তী নির্মাণাধীন ভবনের ৭ তলার দেয়াল ধসে পড়ে সাইফুল ইসলাম সাগর নামে ৫ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। সোমবার বেলা ১১টার দিকে জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার নোয়াগাঁও চৌমুহনী এলাকায় নুর আইডিয়াল স্কুলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত সাইফুল ইসলাম সাগর (১০) সদর দক্ষিণ উপজেলার শাকতলা গ্রামের অলি হোসেনের ছেলে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, নুর আইডিয়াল স্কুলের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম সাগর প্রতিদিনের ন্যায় সোমবার সকালে বিদ্যালয়ে যায়। ক্লাস চলা অবস্থায় বিদ্যালয়ের পূর্বপাশে নির্মাণাধীন ৭ তলা ভবনের একটি দেয়াল ভেঙ্গে ওই বিদ্যালয়ের টিনশেড ভবনে পড়ে। এ সময় বিদ্যালয়ের চাল ভেঙে ওই শিক্ষার্থীর মাথায় পড়লে সে গুরুতর আহত হয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনায় অল্পের জন্য রক্ষা পায় ওই ক্লাসে থাকা শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষার্থীরা।
সদর দক্ষিণ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খাদেমুল বাহার জানান, খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল বিদ্যালয়ের চালে পড়লে তা ভেঙে শিক্ষার্থীর মাথায় পড়ে। এতে সে গুরুতর আহত হয় এবং পরবর্তীতে সে মারা যায়। এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে এক যুবক মারা গেছেন। সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বায়েজিদের চন্দ্রনগর কলাবাগান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহত যুবকের নাম সাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬)। তিনি নির্মাণাধীন ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ধসে পড়া দেয়ালচাপা পড়েন। এতে তার মৃত্যু হয়।
বায়েজিদ ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. কামরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।