Sylhet ০৬:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সিলেটে শতকোটি টাকার ‘বেওয়ারিশ’ হাসপাতাল

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ৬ দশমিক ৯৮ একর জায়গার ওপর এই জেলা হাসপাতাল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণপূর্ত অধিদপ্তর হাসপাতালটির অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।

গত রোববার হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, এখনও এর চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়নি। ভবনের সামনের অংশে কাজ চলছে। এক্সক্যাভেটর মেশিন দিয়ে মাটি সমান করার কাজ হচ্ছে।

ভবনের ভেতরে চলছে ধোয়ামোছার কাজ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক মওদুদ আহমদ জানান, তাদের কাজ শেষ। লিফটের দরপত্রও সম্পন্ন হয়েছে। লিফটের কাজের জন্য লোকজন আসা-যাওয়া করছে। বাউন্ডারি দেয়াল তাদের প্রতিষ্ঠানের আওতার বাইরে। এটির জন্য আলাদা দরপত্র দেওয়া হলে যে কেউ এসে কাজ করবে। তবে তারা ভবনটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাছে তুলে দিতে প্রস্তুত।
জানা গেছে, হাসপাতাল ভবন নির্মাণ শেষ হলেও ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল সার্জন কার্যালয় নাকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা পরিচালনা করবে, সেটি এখনও নির্ধারণ হয়নি। হাসপাতাল হস্তান্তরের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ না পাওয়ায় গণপূর্ত বিভাগ এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছে।

গণপূর্ত বিভাগ জানায়, ১৫ তলা হাসপাতাল ভবনে আটতলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ। রঙের কাজ, ইলেকট্রিক, টাইলস, গ্লাস, দরজা, জানালা লাগানোও সম্পন্ন। হাসপাতাল ভবনের বেজমেন্টে রয়েছে কারপার্কিং; প্রথম তলায় টিকিট কাউন্টার, ওয়েটিং রুম; দ্বিতীয় তলায় আউটডোর, রিপোর্ট ডেলিভারি ও কনসালট্যান্ট চেম্বার; তৃতীয় তলায় ডায়াগনস্টিক; চতুর্থ তলায় কার্ডিয়াক ও জেনারেল ওটি, আইসিসিইউ, সিসিইউ; পঞ্চম তলায় গাইনি বিভাগ, অপথালমোলজি, অর্থপেডিক্স ও ইএনটি বিভাগ এবং ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম তলায় ওয়ার্ড ও কেবিন। এর মধ্যে আইসিইউ বেড ১৯টি, সিসিইউ বেড ৯টি এবং ৪০টি কেবিন রয়েছে।

গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু জাফর বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভবন হস্তান্তর করে দেবে যে কোনো সময়। এখন সংশ্লিষ্টদের কাছে তুলে দিতে চাই; কিন্তু কেউ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। তারা যে নির্দেশনা দেবে, সেভাবেই কাজ করা হবে।’ স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়হীনতার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সমন্বয় হয়নি, তা ঠিক নয়। টেন্ডার শিডিউল, নকশাসহ কাগজপত্র সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। প্রতিতলায় ছাদ ঢালাইয়ের সময় তারা এসেছিল। এই হাসপাতালের জমি, ভবন, টাকা– সব দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়; আমরা শুধু কাজ করে দিচ্ছি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে হাসপাতালটি পরিচালনা বা তদারকির কথা ছিল। আমরা মন্ত্রণালয়কে সেভাবেই চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব যখন মন্ত্রণালয়ে যায়, তখন গণপূর্ত বিভাগ আমাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেনি। শুনেছি, হাসপাতালের কাজ শেষ। এখন তারা আমাদের গছাতে চাচ্ছে। অথচ এখানে কী আছে, না আছে– সেটি আমাদের জানা নেই। তাই এ অবস্থায় আমরা হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে পারি না। কারণ, আমাদের আগের পরিচালক (ডা. হিমাংশু লাল) এ বিষয়ে চিঠি দিয়ে গেছেন মন্ত্রণালয়ে। তাতে তিনি লিখে যান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অগোচরেই সিলেটে অনেক স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। তারা যেন না বুঝে এসব স্থাপনার দায়িত্ব কোনোভাবেই না নেন।’

সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, ‘হাসপাতালের স্থাপত্য নকশা, কর্মপরিকল্পনা, সেবা প্রদানের জন্য সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় কক্ষের সুবিন্যাসকরণ ইত্যাদির কাগজপত্র সিভিল সার্জন, বিভাগীয় পরিচালক অথবা ওসমানী হাসপাতালের পরিচালকের কাছে দাখিল করা হয়নি। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এটি বাসাবাড়ি নয়; আমাকে দায়িত্ব দিয়ে দিল আর নিয়ে নিলাম। এটি একটি হাসপাতাল। এটি নির্মাণে আমাদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় করা হয়নি।’

ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘যেখানে আমি বিশাল একটি হাসপাতাল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে এটির দায়িত্ব কীভাবে নেব? আমরা সব সময় একটা ভুল প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়ে চলছি। আটতলাবিশিষ্ট ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতাল দেখভাল করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক বা সিভিল সার্জনের আওতাধীন তত্ত্বাবধায়কের সেটি দেখভাল করার কথা। এ বিষয়ে আমি অনেকবার চিঠিও দিয়েছি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।’

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের সিলেট জেলা সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এমন ঠেলাঠেলি বন্ধ হোক। এখানে কারও স্বার্থ বা কোনো কুচক্রী মহল আছে কিনা, সেটি খুঁজে দেখা দরকার। এ প্রকল্প যখন পাস হয়, তখনই বলে দেওয়া হয়েছে কারা পরিচালনা করবে। নির্মাণের পর কেউ দায় নিতে না চাওয়া অন্য অর্থ বহন করে।

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জগন্নাথপুর যুব জমিয়তের নবনির্বাচিত কমিটির পরিচিতি শপথ অনুষ্ঠিত

সিলেটে শতকোটি টাকার ‘বেওয়ারিশ’ হাসপাতাল

প্রকাশের সময় : ০২:৩৪:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ মে ২০২৪

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ৬ দশমিক ৯৮ একর জায়গার ওপর এই জেলা হাসপাতাল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণপূর্ত অধিদপ্তর হাসপাতালটির অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।

গত রোববার হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, এখনও এর চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়নি। ভবনের সামনের অংশে কাজ চলছে। এক্সক্যাভেটর মেশিন দিয়ে মাটি সমান করার কাজ হচ্ছে।

ভবনের ভেতরে চলছে ধোয়ামোছার কাজ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক মওদুদ আহমদ জানান, তাদের কাজ শেষ। লিফটের দরপত্রও সম্পন্ন হয়েছে। লিফটের কাজের জন্য লোকজন আসা-যাওয়া করছে। বাউন্ডারি দেয়াল তাদের প্রতিষ্ঠানের আওতার বাইরে। এটির জন্য আলাদা দরপত্র দেওয়া হলে যে কেউ এসে কাজ করবে। তবে তারা ভবনটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাছে তুলে দিতে প্রস্তুত।
জানা গেছে, হাসপাতাল ভবন নির্মাণ শেষ হলেও ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল সার্জন কার্যালয় নাকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা পরিচালনা করবে, সেটি এখনও নির্ধারণ হয়নি। হাসপাতাল হস্তান্তরের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ না পাওয়ায় গণপূর্ত বিভাগ এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছে।

গণপূর্ত বিভাগ জানায়, ১৫ তলা হাসপাতাল ভবনে আটতলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ। রঙের কাজ, ইলেকট্রিক, টাইলস, গ্লাস, দরজা, জানালা লাগানোও সম্পন্ন। হাসপাতাল ভবনের বেজমেন্টে রয়েছে কারপার্কিং; প্রথম তলায় টিকিট কাউন্টার, ওয়েটিং রুম; দ্বিতীয় তলায় আউটডোর, রিপোর্ট ডেলিভারি ও কনসালট্যান্ট চেম্বার; তৃতীয় তলায় ডায়াগনস্টিক; চতুর্থ তলায় কার্ডিয়াক ও জেনারেল ওটি, আইসিসিইউ, সিসিইউ; পঞ্চম তলায় গাইনি বিভাগ, অপথালমোলজি, অর্থপেডিক্স ও ইএনটি বিভাগ এবং ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম তলায় ওয়ার্ড ও কেবিন। এর মধ্যে আইসিইউ বেড ১৯টি, সিসিইউ বেড ৯টি এবং ৪০টি কেবিন রয়েছে।

গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু জাফর বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভবন হস্তান্তর করে দেবে যে কোনো সময়। এখন সংশ্লিষ্টদের কাছে তুলে দিতে চাই; কিন্তু কেউ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। তারা যে নির্দেশনা দেবে, সেভাবেই কাজ করা হবে।’ স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়হীনতার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সমন্বয় হয়নি, তা ঠিক নয়। টেন্ডার শিডিউল, নকশাসহ কাগজপত্র সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। প্রতিতলায় ছাদ ঢালাইয়ের সময় তারা এসেছিল। এই হাসপাতালের জমি, ভবন, টাকা– সব দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়; আমরা শুধু কাজ করে দিচ্ছি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে হাসপাতালটি পরিচালনা বা তদারকির কথা ছিল। আমরা মন্ত্রণালয়কে সেভাবেই চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব যখন মন্ত্রণালয়ে যায়, তখন গণপূর্ত বিভাগ আমাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেনি। শুনেছি, হাসপাতালের কাজ শেষ। এখন তারা আমাদের গছাতে চাচ্ছে। অথচ এখানে কী আছে, না আছে– সেটি আমাদের জানা নেই। তাই এ অবস্থায় আমরা হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে পারি না। কারণ, আমাদের আগের পরিচালক (ডা. হিমাংশু লাল) এ বিষয়ে চিঠি দিয়ে গেছেন মন্ত্রণালয়ে। তাতে তিনি লিখে যান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অগোচরেই সিলেটে অনেক স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। তারা যেন না বুঝে এসব স্থাপনার দায়িত্ব কোনোভাবেই না নেন।’

সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, ‘হাসপাতালের স্থাপত্য নকশা, কর্মপরিকল্পনা, সেবা প্রদানের জন্য সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় কক্ষের সুবিন্যাসকরণ ইত্যাদির কাগজপত্র সিভিল সার্জন, বিভাগীয় পরিচালক অথবা ওসমানী হাসপাতালের পরিচালকের কাছে দাখিল করা হয়নি। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এটি বাসাবাড়ি নয়; আমাকে দায়িত্ব দিয়ে দিল আর নিয়ে নিলাম। এটি একটি হাসপাতাল। এটি নির্মাণে আমাদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় করা হয়নি।’

ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘যেখানে আমি বিশাল একটি হাসপাতাল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে এটির দায়িত্ব কীভাবে নেব? আমরা সব সময় একটা ভুল প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়ে চলছি। আটতলাবিশিষ্ট ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতাল দেখভাল করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক বা সিভিল সার্জনের আওতাধীন তত্ত্বাবধায়কের সেটি দেখভাল করার কথা। এ বিষয়ে আমি অনেকবার চিঠিও দিয়েছি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।’

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের সিলেট জেলা সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এমন ঠেলাঠেলি বন্ধ হোক। এখানে কারও স্বার্থ বা কোনো কুচক্রী মহল আছে কিনা, সেটি খুঁজে দেখা দরকার। এ প্রকল্প যখন পাস হয়, তখনই বলে দেওয়া হয়েছে কারা পরিচালনা করবে। নির্মাণের পর কেউ দায় নিতে না চাওয়া অন্য অর্থ বহন করে।