Sylhet ০৫:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাংবাদিকতার ৪২ বছরের জীবনে মানবিক সাংবাদিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন শংকর রায়

  • অমিত দেব::
  • প্রকাশের সময় : ০২:০৬:১৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
  • ৮২
  • সাংবাদিকতার ৪২ বছরের জীবনে মানবিক সাংবাদিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন  শংকর রায়। বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সরব ছিলেন। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত প্রয়োজন কে তুচ্ছ করে মানুষের অধিকার আদায়ের প্রয়োজনে ছুটেছেন অবিরাম। বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে পেশার অপব্যবহার ও ক্ষমতার দাপট দেখাননি।

১৯৮২ সালে সিলেট শহর থেকে হিমাংশু শেখর ধরের সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশবার্তা পত্রিকার জগন্নাথপুর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতা পেশায় আগমন। সেই থেকে নিয়মিত এ পেশায় দায়িত্ব পালন। নেশা কখন পেশায় পরিণত হয়েছে তা হয়তো নিজেই জানতেন না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত একটানা চার দশক  কাজ করে গেছেন সাংবাদিক হিসেবে। মফস্বল এলাকায় ফুলটাইম দীর্ঘ সময় সাংবাদিকতা করা কঠিন। অধিকাংশ গণমাধ্যমের কর্তব্যক্তিরা মফস্বলের সাংবাদিকদের বিনে পয়সায় বা যৎসামান্য সুবিধা দিয়ে কাটায়।

জগন্নাথপুর প্রেসক্লাব সভাপতি দৈনিক মানবজমিন/ উত্তরপূর্ব  পত্রিকার জগন্নাথপুর উপজেলা প্রতিনিধি ও জগন্নাথপুরের প্রথম অনলাইন পোর্টাল জগন্নাথপুর  টুয়েন্টি ফোর ডটকমের প্রধান উপদেষ্টা প্রয়াত শংকর রায় সোমবার রাত আড়াইটায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মঙ্গলবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শশ্মানঘাটে তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠান হয়। সেই সাথে অবসান হয়  ৪২ বছরের ভালোবাসার নেশা সাংবাদিকতার। মৃত্যু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এ চিরন্তন সত্য সবার জানা।তারপরও কিছু কিছু মৃত্যুর মুহুর্ত মেনে নেওয়া কষ্টকর। শংকর রায়ের মৃত্যু তেমনি ভাবে হৃদয় কে পোড়াচ্ছ। সোমবার সারাদিন একসঙ্গে অফিসে (জগন্নাথপুর টুয়েন্টি ফোর ডটকম কার্যালয়) সময় কাটানোর পর রাত আটটায় জগন্নাথপুর বাজারে মোহিনী ফার্মেসির সামনে  সহকর্মী জুয়েল, বন্ধু বকুল, রজত মিলে কিছু সময় কথাবার্তার পর বিদায় নিয়ে বাড়ি যান। রাত ১০ টায় আবারো মুঠোফোনে আমার সঙ্গে  আলোচনা। পারিবারিক বিষয়াদি থেকে সাংবাদিকতা সব বিষয় ছাপিয়ে রাত আড়াইটায় ছোটভাই সজিব রায় দুর্জয়ের ফোন। দাদা সব শেষ হয়ে গেছে শংকর কাকা হয়তো  আর নেই। তাকে সিলেট পাঠানো হয়েছে। সেই থেকে স্তব্ধ। ভোরের সূর্য উদয়ের আগেই বন্ধু আলী আহমেদ কে ফোন দিয়ে একসঙ্গে তাদের বাড়িতে যাই। স্বজনদের আগমনে বাড়তে থাকে কান্নার শব্দ। শোকার্ত মানুষের উপস্থিতি ঢল নামে শবদেহের পাশে। ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁর সুকীর্তি আলোচিত হয়।

শংকর রায় ১৯৫৮ সালে জগন্নাথপুর পৌর শহরের বাড়ী জগন্নাথপুর গ্রামের গিরিন্দ্র রায় ও প্রতিমা বালা রায় দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই ৫ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তীতে ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও অত্র অঞ্চলের ন্যাপের বড় নেতারা দলবদল করলেও রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় হলেও তিনি সেই আর্দশ লালন করেই কাটান বাকী জীবন। ১৯৮২ সাল থেকে সক্রিয় সাংবাদিকতা শুরু। দেশবার্তা থেকে দৈনিক খবর এবং খবর গ্রুপের ম্যাগাজিনগুলোতে লেখালেখি।

১৯৭৪ সালে স্বরূপ চন্দ্র সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে  এসএসসি পাশ করেন। পরে বাবার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৮ সালে একঝাঁক বন্ধু মিলে জগন্নাথপুরে প্রতিষ্ঠা করেন নাট্যবাণী নামে একটি সামাজিক সংগঠন। সেই সংগঠনের ব্যানারে অসংখ্য নাটক মঞ্চস্হ হয়। এতে তিনি নিজে অভিনয় করেন। এসব নাটকে দেশের জাতীয় পর্যায়ের অভিনয়শিল্পীরা অভিনয় করেন। তিনি নিজে গান গাইতেন। জাতীয় দিবস সমূহে তাঁর কন্ঠে রণসঙ্গীত “ভয় কি মরনে থাকিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমরও রঙ্গে” কিংবা “ইস্টিশনের রেলগাড়িটা , মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা” শোনার জন্য অপেক্ষায় থাকতো সংস্কৃতি অনুরাগীরা।

তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। বাপদাদার ভিটা জগন্নাথপুর বাজারের বড়গলিতে দীর্ঘদিন করেছেন ব্যবসা। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে সাংবাদিকদের নিয়ে আড্ডা ছিল নিত্যদিনের রুটিন। ১৯৮৬ সালে প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন এ কমিটিতে অ্যাডভোকেট শায়েক আহমেদ সভাপতি ও দিলোয়ার হোসেন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ কমিটি জগন্নাথপুর কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে। ১৯৯০ সালের পর থেকে তিনি আমৃত্যু প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে মাসিক জগন্নাথপুর বার্তা পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ও পরবতীতে পাক্ষিক জগন্নাথপুর দর্পন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে মানবজমিন পত্রিকার দেশ সেরা ১০ প্রতিনিধির একজন হিসেবে স্বীকৃতি পান।  কপি হাউজের আড্ডার মতো আড্ডায় আড্ডায় এক সময় তাঁর ব্যবসা শেষ হয়ে যায়। তারপরও ছাড়েননি সাংবাদিকতা। লেটার প্রেসের ছাপা পত্রিকায় ডাক বিভাগের মাধ্যমে নিউজ পোষ্ট করে অপেক্ষার প্রহরগোনা সাংবাদিকতার দিন বদলের সঙ্গে তিনি নিজেও তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি আয়ত্ত করে ডিজিটাল অনলাইন সাংবাদিকতায় নিজেকে তৈরি করেন। এতটা সক্রিয় ছিলেন যা লিখে বুঝানোর ভাষা সম্ভব নয়।

তথ্যের প্রয়োজনে প্রতিদিন তাঁর অনুসন্ধান খুব মিস  করব। এমন শুন্যতা কীভাবে পূরন হবে ভাবলেই বুকে চিন চিন ব্যথা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুললক্ষ্যে তিনি সরব ছিলেন। গত ২৬ মার্চ প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে রাত ১২ টায় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন, ফুল নিয়ে তিনি হাজির। জাতীয় দিবস সমূহে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন ফুল তিনি নিজে তৈরি করে নিয়ে আসতেন। উপজেলা প্রশাসনের দিবস কেন্দ্রীক বিভিন্ন সভা সমাবেশ সেমিনারে তিনি যথাসময়ে উপস্থিত। ২০১৭ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বেশকিছু দিন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হার্ট ফাউন্ডেশনে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। ২০২৩ সালে আবারো কোমরে ব্যথা নিয়ে স্বাভাবিক চলাফেরা বিঘ্নিত হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে সুস্থ হয়ে উঠেন। আবারো কর্মচাঞ্চল্যতা সরব সাংবাদিকতায় শংকর দা। জগন্নাথপুর টুয়েন্টি ফোর ডটকম অফিস জমে উঠত আলী আহমেদ, জুয়েলদের দাদার সঙ্গে মজাদার আড্ডায়। বয়সের ব্যবধান ভুলে আমরা মেতে উঠতাম পরম বন্ধুত্বে।

২২ এপ্রিল সারাদিন প্রিয় অফিস জগন্নাথপুর টুয়েন্টি ফোর  কার্যালয়ে আমাদের  সঙ্গে সময় কাটান। রাত ১ টায় খাওয়া ধাওয়া শেষ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেন। হঠাৎ বুকে ব্যথা অসি্হরতা অনুভব করেন। চিকিৎসক সুব্রত রায়ের পরামর্শে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে রওয়ানা হন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন।  সাথে সাথে তাকে নিয়ে রওয়ানা হলে ৪৫ কিলোমিটার দূর সিলেট শহরের দিকে। পৌঁছার আগেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শী বাড়ী জগন্নাথপুর গ্রামের বাসিন্দা সজীব রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে  জানান, শংকর রায় হাসপাতালে হৃদরোগের কোন চিকিৎসা পাননি। হাসপাতালে  যাওয়ার সাথে সাথে তাকে সিলেট রেফার্ড করা হয়। জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রোগী নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা কোন চিকিৎসা না দিয়ে সিলেট রেফার্ড করে দায়িত্ব সারেন। এমন অভিযোগ নাগরিকদের কাছ থেকে প্রায়ই শোনা যায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নানা কর্মসূচিতে ওতপ্রতভাবে জড়িত শংকর রায়ের সঙ্গে সবার ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এরপরও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা পাননি এই কষ্ট আমাদেরকে পীড়িত করছে। জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শারমিন আরা আশা তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে সমবেদনা জানিয়েছেন। জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের রোগীদের জরুরি মুহুর্তে কোন চিকিৎসা না দিয়ে সিলেট রেফার্ডের প্রবণতা দীর্ঘদিনের এ তৎপরতা থেকে কবে বেরিয়ে এসে মানবিক চিকিৎসক হবেন তাঁরা জানি না। চিকিৎসকদের বিবেক ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত না হলে সুচিকিৎসা  না পেয়ে আমাদেরকে এভাবে হারিয়ে যেতে হবে ।

খবরের সন্ধানে প্রতিনিয়ত ছুঁটে চলা শংকর রায় একজন মানবিক সাংবাদিক ছিলেন। সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছুটে গেছেন এক দপ্তর  থেকে আরেক দপ্তরে । মানবিক সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করে গেছেন তিনি। তাঁর আকস্মিক  মৃত্যুর খবর স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। একজন সদালাপী বিনয়ী সাদামনের মানুষ সাংবাদিক সমাজের  নেতা ও অভিভাবকের শুন্যতা অপূরনীয়। তিনি তাঁর কৃতকর্মে শ্রদ্ধা ভালোবাসায় অনন্তকাল থাকবেন জগন্নাথপুরবাসীর হৃদয়ে। পরপারে ভালো থাকুন দাদা।

শংকর রায় জন্ম ৫ জুন ১৯৫৮, মৃত্যু ২২ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।

লেখক:: সম্পাদক ও প্রকাশক

জগন্নাথপুর টোয়েন্টিফোর ডট কম

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জগন্নাথপুর যুব জমিয়তের নবনির্বাচিত কমিটির পরিচিতি শপথ অনুষ্ঠিত

সাংবাদিকতার ৪২ বছরের জীবনে মানবিক সাংবাদিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন শংকর রায়

প্রকাশের সময় : ০২:০৬:১৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
  • সাংবাদিকতার ৪২ বছরের জীবনে মানবিক সাংবাদিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন  শংকর রায়। বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সরব ছিলেন। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত প্রয়োজন কে তুচ্ছ করে মানুষের অধিকার আদায়ের প্রয়োজনে ছুটেছেন অবিরাম। বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে পেশার অপব্যবহার ও ক্ষমতার দাপট দেখাননি।

১৯৮২ সালে সিলেট শহর থেকে হিমাংশু শেখর ধরের সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশবার্তা পত্রিকার জগন্নাথপুর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতা পেশায় আগমন। সেই থেকে নিয়মিত এ পেশায় দায়িত্ব পালন। নেশা কখন পেশায় পরিণত হয়েছে তা হয়তো নিজেই জানতেন না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত একটানা চার দশক  কাজ করে গেছেন সাংবাদিক হিসেবে। মফস্বল এলাকায় ফুলটাইম দীর্ঘ সময় সাংবাদিকতা করা কঠিন। অধিকাংশ গণমাধ্যমের কর্তব্যক্তিরা মফস্বলের সাংবাদিকদের বিনে পয়সায় বা যৎসামান্য সুবিধা দিয়ে কাটায়।

জগন্নাথপুর প্রেসক্লাব সভাপতি দৈনিক মানবজমিন/ উত্তরপূর্ব  পত্রিকার জগন্নাথপুর উপজেলা প্রতিনিধি ও জগন্নাথপুরের প্রথম অনলাইন পোর্টাল জগন্নাথপুর  টুয়েন্টি ফোর ডটকমের প্রধান উপদেষ্টা প্রয়াত শংকর রায় সোমবার রাত আড়াইটায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মঙ্গলবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শশ্মানঘাটে তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠান হয়। সেই সাথে অবসান হয়  ৪২ বছরের ভালোবাসার নেশা সাংবাদিকতার। মৃত্যু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এ চিরন্তন সত্য সবার জানা।তারপরও কিছু কিছু মৃত্যুর মুহুর্ত মেনে নেওয়া কষ্টকর। শংকর রায়ের মৃত্যু তেমনি ভাবে হৃদয় কে পোড়াচ্ছ। সোমবার সারাদিন একসঙ্গে অফিসে (জগন্নাথপুর টুয়েন্টি ফোর ডটকম কার্যালয়) সময় কাটানোর পর রাত আটটায় জগন্নাথপুর বাজারে মোহিনী ফার্মেসির সামনে  সহকর্মী জুয়েল, বন্ধু বকুল, রজত মিলে কিছু সময় কথাবার্তার পর বিদায় নিয়ে বাড়ি যান। রাত ১০ টায় আবারো মুঠোফোনে আমার সঙ্গে  আলোচনা। পারিবারিক বিষয়াদি থেকে সাংবাদিকতা সব বিষয় ছাপিয়ে রাত আড়াইটায় ছোটভাই সজিব রায় দুর্জয়ের ফোন। দাদা সব শেষ হয়ে গেছে শংকর কাকা হয়তো  আর নেই। তাকে সিলেট পাঠানো হয়েছে। সেই থেকে স্তব্ধ। ভোরের সূর্য উদয়ের আগেই বন্ধু আলী আহমেদ কে ফোন দিয়ে একসঙ্গে তাদের বাড়িতে যাই। স্বজনদের আগমনে বাড়তে থাকে কান্নার শব্দ। শোকার্ত মানুষের উপস্থিতি ঢল নামে শবদেহের পাশে। ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁর সুকীর্তি আলোচিত হয়।

শংকর রায় ১৯৫৮ সালে জগন্নাথপুর পৌর শহরের বাড়ী জগন্নাথপুর গ্রামের গিরিন্দ্র রায় ও প্রতিমা বালা রায় দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই ৫ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তীতে ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও অত্র অঞ্চলের ন্যাপের বড় নেতারা দলবদল করলেও রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় হলেও তিনি সেই আর্দশ লালন করেই কাটান বাকী জীবন। ১৯৮২ সাল থেকে সক্রিয় সাংবাদিকতা শুরু। দেশবার্তা থেকে দৈনিক খবর এবং খবর গ্রুপের ম্যাগাজিনগুলোতে লেখালেখি।

১৯৭৪ সালে স্বরূপ চন্দ্র সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে  এসএসসি পাশ করেন। পরে বাবার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৮ সালে একঝাঁক বন্ধু মিলে জগন্নাথপুরে প্রতিষ্ঠা করেন নাট্যবাণী নামে একটি সামাজিক সংগঠন। সেই সংগঠনের ব্যানারে অসংখ্য নাটক মঞ্চস্হ হয়। এতে তিনি নিজে অভিনয় করেন। এসব নাটকে দেশের জাতীয় পর্যায়ের অভিনয়শিল্পীরা অভিনয় করেন। তিনি নিজে গান গাইতেন। জাতীয় দিবস সমূহে তাঁর কন্ঠে রণসঙ্গীত “ভয় কি মরনে থাকিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমরও রঙ্গে” কিংবা “ইস্টিশনের রেলগাড়িটা , মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা” শোনার জন্য অপেক্ষায় থাকতো সংস্কৃতি অনুরাগীরা।

তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। বাপদাদার ভিটা জগন্নাথপুর বাজারের বড়গলিতে দীর্ঘদিন করেছেন ব্যবসা। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে সাংবাদিকদের নিয়ে আড্ডা ছিল নিত্যদিনের রুটিন। ১৯৮৬ সালে প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন এ কমিটিতে অ্যাডভোকেট শায়েক আহমেদ সভাপতি ও দিলোয়ার হোসেন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ কমিটি জগন্নাথপুর কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে। ১৯৯০ সালের পর থেকে তিনি আমৃত্যু প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে মাসিক জগন্নাথপুর বার্তা পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ও পরবতীতে পাক্ষিক জগন্নাথপুর দর্পন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে মানবজমিন পত্রিকার দেশ সেরা ১০ প্রতিনিধির একজন হিসেবে স্বীকৃতি পান।  কপি হাউজের আড্ডার মতো আড্ডায় আড্ডায় এক সময় তাঁর ব্যবসা শেষ হয়ে যায়। তারপরও ছাড়েননি সাংবাদিকতা। লেটার প্রেসের ছাপা পত্রিকায় ডাক বিভাগের মাধ্যমে নিউজ পোষ্ট করে অপেক্ষার প্রহরগোনা সাংবাদিকতার দিন বদলের সঙ্গে তিনি নিজেও তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি আয়ত্ত করে ডিজিটাল অনলাইন সাংবাদিকতায় নিজেকে তৈরি করেন। এতটা সক্রিয় ছিলেন যা লিখে বুঝানোর ভাষা সম্ভব নয়।

তথ্যের প্রয়োজনে প্রতিদিন তাঁর অনুসন্ধান খুব মিস  করব। এমন শুন্যতা কীভাবে পূরন হবে ভাবলেই বুকে চিন চিন ব্যথা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুললক্ষ্যে তিনি সরব ছিলেন। গত ২৬ মার্চ প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে রাত ১২ টায় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন, ফুল নিয়ে তিনি হাজির। জাতীয় দিবস সমূহে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন ফুল তিনি নিজে তৈরি করে নিয়ে আসতেন। উপজেলা প্রশাসনের দিবস কেন্দ্রীক বিভিন্ন সভা সমাবেশ সেমিনারে তিনি যথাসময়ে উপস্থিত। ২০১৭ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বেশকিছু দিন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হার্ট ফাউন্ডেশনে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। ২০২৩ সালে আবারো কোমরে ব্যথা নিয়ে স্বাভাবিক চলাফেরা বিঘ্নিত হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে সুস্থ হয়ে উঠেন। আবারো কর্মচাঞ্চল্যতা সরব সাংবাদিকতায় শংকর দা। জগন্নাথপুর টুয়েন্টি ফোর ডটকম অফিস জমে উঠত আলী আহমেদ, জুয়েলদের দাদার সঙ্গে মজাদার আড্ডায়। বয়সের ব্যবধান ভুলে আমরা মেতে উঠতাম পরম বন্ধুত্বে।

২২ এপ্রিল সারাদিন প্রিয় অফিস জগন্নাথপুর টুয়েন্টি ফোর  কার্যালয়ে আমাদের  সঙ্গে সময় কাটান। রাত ১ টায় খাওয়া ধাওয়া শেষ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেন। হঠাৎ বুকে ব্যথা অসি্হরতা অনুভব করেন। চিকিৎসক সুব্রত রায়ের পরামর্শে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে রওয়ানা হন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন।  সাথে সাথে তাকে নিয়ে রওয়ানা হলে ৪৫ কিলোমিটার দূর সিলেট শহরের দিকে। পৌঁছার আগেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শী বাড়ী জগন্নাথপুর গ্রামের বাসিন্দা সজীব রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে  জানান, শংকর রায় হাসপাতালে হৃদরোগের কোন চিকিৎসা পাননি। হাসপাতালে  যাওয়ার সাথে সাথে তাকে সিলেট রেফার্ড করা হয়। জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রোগী নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা কোন চিকিৎসা না দিয়ে সিলেট রেফার্ড করে দায়িত্ব সারেন। এমন অভিযোগ নাগরিকদের কাছ থেকে প্রায়ই শোনা যায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নানা কর্মসূচিতে ওতপ্রতভাবে জড়িত শংকর রায়ের সঙ্গে সবার ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এরপরও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা পাননি এই কষ্ট আমাদেরকে পীড়িত করছে। জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শারমিন আরা আশা তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে সমবেদনা জানিয়েছেন। জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের রোগীদের জরুরি মুহুর্তে কোন চিকিৎসা না দিয়ে সিলেট রেফার্ডের প্রবণতা দীর্ঘদিনের এ তৎপরতা থেকে কবে বেরিয়ে এসে মানবিক চিকিৎসক হবেন তাঁরা জানি না। চিকিৎসকদের বিবেক ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত না হলে সুচিকিৎসা  না পেয়ে আমাদেরকে এভাবে হারিয়ে যেতে হবে ।

খবরের সন্ধানে প্রতিনিয়ত ছুঁটে চলা শংকর রায় একজন মানবিক সাংবাদিক ছিলেন। সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছুটে গেছেন এক দপ্তর  থেকে আরেক দপ্তরে । মানবিক সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করে গেছেন তিনি। তাঁর আকস্মিক  মৃত্যুর খবর স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। একজন সদালাপী বিনয়ী সাদামনের মানুষ সাংবাদিক সমাজের  নেতা ও অভিভাবকের শুন্যতা অপূরনীয়। তিনি তাঁর কৃতকর্মে শ্রদ্ধা ভালোবাসায় অনন্তকাল থাকবেন জগন্নাথপুরবাসীর হৃদয়ে। পরপারে ভালো থাকুন দাদা।

শংকর রায় জন্ম ৫ জুন ১৯৫৮, মৃত্যু ২২ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।

লেখক:: সম্পাদক ও প্রকাশক

জগন্নাথপুর টোয়েন্টিফোর ডট কম