ধান কাটার ভরা মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টার কেলেংকারী নিয়ে জেলাজুড়ে আলোচনা রয়েছে। কৃষকরা ধান কাটার এই যন্ত্র না পেয়ে হন্যে হয়ে ঘুরছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারের কাছ থেকে ৭০ ভাগ টাকা ভতুর্কি নিয়ে কেনা জেলার ৮৭৩ টি কম্বাইন হারভেস্টারের বড় একট অংশ গোপনে বিক্রয় হয়ে গেছে অন্য জেলায়। এসব ধান কাটার যন্ত্র স্ব স্ব এলাকায় নেই। কিন্তু কৃষি অফিসের তালিকায় এখনো এই কম্বাইন হারভেস্টারকে দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’। কৃষকদের অভিযোগ, কম্বাইন হারভেস্টার কেনা বেচায় কৃষি অফিসের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীর যোগসাজস থাকায় তালিকায় এখনো হারভেস্টার দেখানো হচ্ছে।
শাল্লার হবিবপুর ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামের স্থানীয় ইউপি সদস্য বাবলু রায় ও তার সহোদর পৃতেশ রায়ের নামে দুই বছর আগে ভতুর্তির কম্বাইন হারভেস্টার বরাদ্দ হয়। ইউপি সদস্য বাবলু রায় দুই বছর আগেই তার বরাদ্দের হারভেস্টার বিক্রয় করে দিয়েছেন অন্য জেলায়। কিন্তু এখনো শাল্লার হারভেস্টারের তালিকায় তার নাম (তালিকার ২৫ নম্বরে) রয়েছে। বাবলু রায় নিজেই বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেককে বলেছেন, দেড় লাখ টাকা লাভে তিনি অনেক আগেই হারভেস্টার বিক্রয় করেছেন।
কেবল বাবলু রায় নয়, জেলাজুড়ে তালিকায় থাকা অনেক হারভেস্টার এখন আর এলাকায় নেই। ভতুর্কির এই ধান কাটার যন্ত্র লাখ লাখ টাকা লাভে অন্য জেলায় বিক্রয় করা হয়েছে। এমন তুঘলকি কাজের সঙ্গে কৃষি অফিসের কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীও জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
গেল তিনদিনে জেলার সাত উপজেলায় ৭০ জন কম্বাইন হারভেস্টারের মালিককে ফোন দিয়ে সুখকর তথ্য পাওয়া যায় নি। বেশিরভাগেই তার কেনা হারভেস্টার কোথায় আছে, এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন। কেউ বলেছেন বিকল আছে যন্ত্রটি। কেউ কেউ বার বার ফোন দিলেও রিসিভ করেন নি ফোন।
হারভেস্টারের মালিকের তালিকায় থাকা জামালগঞ্জ উপজেলার ১৫ জনকে একাধিবার ফোন দিলেও রিসিভ করেছেন ৩ জন। ফোন বন্ধ ছিল আট জনের। শাল্লা উপজেলার ১০ জন কে ফোন দিলেও রিসিভ করেছেন চার জন। বিশ^ম্ভরপুরের নয় জনকে ফোন দেওয়া হলেও রিসিভ করেছেন চার জন।
ধর্মপাশা উপজেলার ৭ জন কে ফোন দিলেও রিসিভ করেছেন চার জন। ছাতক উপজেলার ৮ জন কে ফোন দিলেও রিসিভ করেছেন তিন জন। দোয়ারাবাজর উপজেলার নয়জন ফোন দিলে রিসিভ করেছেন তিন জন। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ১২ জন কে ফোন দিলেও রিসিভ করেছেন তিন জন। বেশিরভাগ কম্বাইন হারভেস্টারের মালিকের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
কৃষি অফিসেরই একজন কর্মচারী জানিয়েছেন, অনেক কৃষকের কেবল জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কম্বাইন হারভেস্টারের ব্যবসা করেছেন রাজনৈতিক কর্মী ও কৃষি অফিসের অসৎ কর্মকর্তা—কর্মচারী। অফিসের রেকর্ডে যে ফোন দেওয়া আছে, এটি কোনদিনই পাওয়া যায় নি। শুরু থেকেই এগুলো বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
জামালগঞ্জ উপজেলার রামপুরের তাজউদ্দিন জানালেন, তার কম্বাইন হারভেস্টার নেত্রকোণায় আছে। শরীফপুরের আরশ আলী জানান, তার হারভেস্টার বিকল আছে।
শাল্লার আনন্দপুরের মনোহর রায়, নিজগাঁওয়ের রুহুল আমিন, কাশিপুরের দিপক চন্দ্র দাস একই গ্রামের দিপু চন্দ্র দাস কম্বাইন হারভেস্টার অন্য জেলায় বিক্রয় করেছেন অনেক আগেই। কিন্তু কৃষি অফিসের তালিকায় এখনো ওখানেই দেখানো হচ্ছে। একই এলাকার মৃদুল চন্দ্র দাসের হারভেস্টার তালিকায় অচল দেখালেও এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এটিও অন্য জেলায় বিক্রয় হয়েছে। একই এলাকার আকাশ রায়ের হারভেস্টার কৃষি অফিসের তালিকায় অচল দেখালেও এটি এলাকায় কোনদিন কেউ দেখেইনি বলে জানালেন স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য সুব্রত দাস। বাহাড়া’র দীপংকর দাস ও কাশিপুরের ছালাউদ্দিন আদনানের হারভেস্টারও অন্য জেলায় বিক্রয় করা হয়েছে। কিন্তু এখনো শাল্লার তালিকায় দেখানো হচ্ছে ওই যন্ত্রগুলোকে।
ধর্মপাশার সুখাইড়ের নব কুমার দাসের হারভেস্টার মোহনগঞ্জে বিকল পড়ে আছে বলে জানান তিনি।
ছাতক উপজেলার রাজারগাঁওয়ের ফখরুল হক হারভেস্টার কোথায় জানতে চাইলে ফোন কেটে দেন।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার উলুতুলু গ্রামের আব্দাই মিয়া তার হারভেস্টার কোথায় আছে বলতে পারেননি।
শাল্লার ছায়ার হাওরপাড়ের আনন্দপুরের কৃষক রাখাল দাস ও কাশিপুরের বাবলু মিয়া বললেন, কৃষকের নামে ভুর্তকির ধান কাটার মেশিন নিয়ে তারা ব্যবসা করেছে। আর আমরা হারভেস্টারের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি। ধান কাটার শ্রমিকও মিলছে না। মহাবিপদে পড়েছি।
শাল্লার বড় কৃষক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুস ছাত্তারও জানালেন, হারভেস্টার যন্ত্রের স্বল্পতায় বিপদে পড়েছেন হাজারো কৃষক।
শাল্লার একজন গণমাধ্যম কর্মী জানান, শাল্লা কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিভুতোষ চৌধুরী হারভেস্টার যন্ত্র কেলেংকারীতে সহায়তা করেছেন এমন অভিযোগ অনেক কৃষক জানিয়েছেন।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিভুতোষ চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, তার মাধ্যমে কম্বাইন হারভেস্টার কেনা—বেচা হয়েছে এমন তথ্য সঠিক নয়। এমন অনিয়মের সঙ্গে কখনোই যুক্ত ছিলেন না তিনি ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ—পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বললেন, আমি যোগদান করার পর হারভেস্টার যন্ত্রের বিষয়ে কড়া নজরদারী রাখছি। গেল দুই বছর সকল কম্বাইন হারভেস্টার বিধি মোতাবেক কেনা হয়েছে। তবুও এই বিষয়ে খেঁাজ খবর নেব আমি। তিন বছর পর মালিকানা হস্তান্তর করতে পারেন হারভেস্টার যন্ত্রের মালিকরা। সেক্ষেত্রে ভুর্তকির টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হবে। কৃষি অফিসকে বিষয়টি জানিয়ে হস্তান্তর করতে হবে। কম্বাইন হারভেস্টার সংশ্লিষ্ট এলাকায় নেই, অথচ তালিকায় দেখানো হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই।