‘পরের বাড়িত ঘর বানাইয়া (তৈরি করে) থাকি। আমি বাজারও (পাগলা বাজার) দুই ছেলেরা লইয়া (নিয়ে) ফুটপাত বইয়া (বসে) কাঁচামাল (সবজি) বেচি (বিক্রয় করি)। আমার পরিবারে (স্ত্রী) বাড়িতঔ বিস্কুট—বাস্কুট বেছইন (বিক্রয় করেন), কয়েক মিনিটের মাঝে চাইতে চাইতে ঘর যে নিয়া কওয়াই (কোথায়) পালাইছে খবরঔ নাই, রাইতে পরের বাড়ির বারান্দাত (বারন্দায়) থাকি, হিতানের (মাথা) মাঝে বালিশ দিবারঔ নাই। দিনও ভিটার মাঝে খোলা আকাশের নিচে থাকরাম, অফিসার (প্রশাসনের কর্মকর্তারা), নেতাঅখল (নেতৃবৃন্দ) আইয়া (এসে) গেছইন (গেছেন), অখনো (এখনো) কিচ্ছু (কিছুই) পাইছি না।’
পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের রায়পুর কাজীবাড়ি হাটির আশরাফ আলী (৪৫) মঙ্গলবার দুপুরে কাঁদতে কাঁদতে নিজের কষ্টের কথা এভাবেই বলছিলেন।
পাশে দাঁড়ানো গ্রামের যুবক ফরমান আলী বলছিলেন, ধনী গরিব অনেকেরই একই অবস্থা। ঘর দরজা দুমরে মুচড়ে কোথায় নিয়ে ফেলেছে খেঁাজই পাচ্ছেন না কেউ কেউ। ধনী মানুষেরা যেমন তেমন, গরিব মানুষ খোলা আকাশের নীচেই থাকছেন।
পাগলা বাজারের পাশের হাটির রবিজান. ছুফিয়া খাতুন, ফিরুজা বেগম, পহেলা খাতুন ও আখলিমা বেগম চিৎকার করে কাঁদছিলেন। বসতঘরের পাশের গাছের ছায়ায় বসে এই নারীরা হা—হুতাশ করে বলছিলেন, ‘সর্বনাশ অইগেছে (হয়েছে) বাবা, ঘরও নাই, বাসন—কাসন সব উড়াইয়া (উড়িয়ে) নিছেগি (নিয়ে গেছে), দুইদিন ধইরা না খাওয়া আছি।’
পশ্চিম পাগলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীড়ের সাধারণ সম্পাদক লালন বললেন, ‘২১ বছর আগের করা আমার আধাপাকা কিন্ডার গার্ডেনের (স্কুলঘরের) ভিটের মাটি কেবল আছে। আমি এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি না। গ্রামের মানুষের কথা ভাবছি, সরকারি সহায়তা ছাড়া গ্রামের মানুষের মাথা গেঁাজার ঠাঁই হবে না।’
এই পথ দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পাঁচ বছরের সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়ি পাশের সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গণিপুরে যেতে রওয়ানা দিয়েছেন কান্দিগাঁওয়ের মোমেনা আক্তার। বললেন, আমি বাবার বাড়ি ছিলাম, আমার স্বামী তাবলিগে ঢাকায় গেছেন, বাড়ির ঘর তালা ছিল, এসে কিছুই পাইনি, ঘূর্ণিঝড়ে ঘর কোথায় নিয়ে গেছে চিহৃই পাই নি। বাড়ির টিউবওয়েলের মাথাটাও দূরে নিয়ে ফেলেছে। আমার তো কিছুই নাই, এজন্য বাবার বাড়িতেই চলে যাচ্ছি।’
আশরাফ, মুমেনা, ছুফিয়া, ফিরুজা, পহেলা ও আখলিমার মত অবস্থা এই উপজেলার সাড়ে পাঁচশ পরিবারের দাবি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুকান্ত সাহা’র। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা হাজারের উপরে। ঘূর্ণিঝড়ে শুধু তাদের ঘরই বিধ্বস্ত হয় নি, ভেঙেছে তাদের বেঁচে থাকার শক্তিও। সবকিছু হারিয়ে তারা এখন চেয়ে আছেন মানবিক সহায়তার দিকে। সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা না পেলে, ঘুরে দাড়ানোর স্বপ্ন দেখতে পারবেন না এসব মানুষেরা।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুকান্ত সাহা বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে সাধারণ মানুষের বেশী ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার পশ্চিম পাগলা, জয়কলস এবং দরগাপাশা ইউনিয়নে ঘূর্ণিঝড়ে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ২৫০—৩০০ জনের মতো আহত হয়েছে, তাদেরকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমরা তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছি। পাগলাতে অনস্পট মেডিকেল টিম প্রেরণ করেছিলাম। সোমবার সংসদ সদস্য এমএ মান্নান, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ সহ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছি।
তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়নে ৩০ জনের একটি টিম কাজ করছে। সাড়ে চারশ থেকে পাঁচশ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে তিনশ—সাড়ে তিনশ পরিবারের ঘর—বাড়ি সম্পূর্ণ ভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। সোমবার ২৭০ পরিবারকে শুকনো খাবার এবং চাল বিতরণ করেছি। আজও জেলা প্রশাসক স্যার বিকালে আসবেন, এসময় ৬০টি পরিবারকে আমরা ঢেউটিন বিতরণ করবো। একই সাথে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে ঢেউটিনের চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে। আশাকরি খুব শীঘ্রই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাস করতে পারবো।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ বললেন, আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে খাবার বিতরণ করেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে টিনও বিতরণ করব। যাদের রান্না করার ব্যবস্থা নাই, তাদের কাছে আজ ইফতারের পর খাদ্য পৌঁছাব। উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন, ইউপি চেয়ারম্যান সকলে ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য, বাসস্থানের সমস্যা মেটাতে কাজ করছে।
প্রসঙ্গত, রবিবার রাত ১০ টা ৪০ মিনিটে শান্তিগঞ্জ উপজেলার উপর দিয়ে এই ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়।
সুত্র:সনামগঞ্জের খবর