সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিন (৬) হত্যা মামলার চার আসামিকে ৫ দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করা হয়েছিলো আজ শনিবার (১৬ নভেম্বর)। দুপুর ১টার দিকে আসামিদের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালতে তাদের তোলা হয়। চার আসামির মধ্যে প্রধান অভিযুক্ত শামীমা বেগম মার্জিয়া (২৫) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়ার কথা থাকলেও আদালতে এসে মুখে কুলুপ এঁটে দেন তিনি, দেননি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী। পরে ৪ আসামিকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন বিজ্ঞ বিচারক।
আদালত সূত্র জানায়, মুনতাহা হত্যা মামলার চার আসামি কানাইঘাট থানার বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের মৃত ময়না মিয়ার স্ত্রী আলিফজান (৫৫), তাদের মেয়ে শামীমা বেগম মার্জিয়া (২৫) এবং একই এলাকার ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও নাজমা বেগম (৩৫)-কে পুলিশ ১১ নভেম্বর আদালতে প্রেরণ করে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আদালত সে সময় ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে পুলিশ আসামিদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। জিজ্ঞাসাবাদকালে প্রধান অভিযুক্ত মার্জিয়া নিজের দোষ স্বীকার করে এবং আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিবে বলে পুলিশকে জানায়। তাই রিমান্ডের ৫ দিন শেষে শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ৪ আসামিকে আদালতে তোলা হয়। কিন্তু আদালতে এসে আর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেননি তিনি।
পরে আসামিদের কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন আদালত।
এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিলেট জেলা জজ আদালতের ইন্সপেক্টর মো. জমসেদ আহমদ।
তিনি বলেন- প্রয়োজন মনে করলে পুলিশ আবার তাদের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করবে।
গত ৩ নভেম্বর বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলো কানাইঘাট সদরের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে মুনতাহা আক্তার জেরিন। সেদিন সকালে বাড়ির অদূরে একটি মাদ্রাসার ওয়াজ মাহফিল থেকে ছেলে আব্দুর রহিম ও মেয়ে মুনতাহাকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন শামীম আহমদ। সেখান থেকে তাদের ফল কিনে দেন। এরপর মুনতাহা শিশুদের সঙ্গে বাড়ির সামনের সড়কে খেলতে যায়। বেলা আড়াইটার দিকে খাবার খেতে মুনতাহার ডাক পড়ে। খুঁজতে গিয়েও শিশুটিকে আর পাওয়া যায়নি। এরপর ওইদিন রাত ১২টায় মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ কানাইঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
একদিন-দুদিন-তিনদিন যায়- খোঁজ মিলে না মুনতাহার। এরই মধ্যে ফেসবুকে ঝড় তুলে নিষ্পাপ এই শিশুর নিখোঁজের খবরটি। শোবিজের তারকারা পর্যন্ত ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে মুনতাহার সন্ধান কামনা করেন। তার প্রবাসী ভাই মুনতাহার খোঁজ দিলে আর্থিক পুরস্কার দিবেন বলেও ঘোষণা দেন। কিন্তু মুনতাহা আর জীবিত ফিরে আসেনি। সপ্তাহান্তে মিলে ভয়ঙ্কর খবর। মুনতাহাকে হত্যার পর মরদেহ বাড়ির পাশের একটি খালে কাঁদামাটিতে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল এই কদিন।
হত্যাকাণ্ডটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাপা দেওয়া অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন মর্জিয়ার মা আলিফজান। ১০ নভেম্বর ভোররাত ৪টার দিকে মুনতাহার মরদেহ কোলে তুলে পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে স্থানীয়রা তাকে হাতেনাতে আটক করেন।
এই ঘটনায় অভিযুক্ত মর্জিয়া আক্তার, তার মা আলীফজান ও আলীফজানের মা কুতুবজানকে আটক করা হয়। ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতা মার্জিয়ার বসতঘর গুড়িয়ে দেন। শিশু সন্তানের গলিত নিথর দেহ দেখে শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো দেশ।
স্থানীয়রা জানান, মুনতাহাকে ২৫০ টাকায় প্রাইভেট পড়াতেন মর্জিয়া। তার মা আলিফজান ভিক্ষাবৃত্তি করতেন। ঘরে তার আশি বছরের বেশি বয়সী নানি কুতুবজান ছিলেন। মর্জিয়া চুরির ঘটনায় এবং তার চলাফেরা খারাপ প্রতীয়মান হওয়াতে টিউশনি থেকে তাকে বাদ দেয় মুনতাহার পরিবার। সেই ক্ষোভে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেন মর্জিয়া। পরিবারের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শিশু মর্জিয়াকে অপহরণের পর হত্যা করেন তিনি।
জনতার হাতে আটকের পর মর্জিয়ার মা আলিফজান বেগম বলেন, ‘অপহরণের পর মর্জিয়াকে আটকাতে চেয়েছিলেন। তখন মেয়ে তাকে বলে টাকা ৫ লাখ পাইমু, আমি আরো দুইটা শিশু আনিয়া দিতাম। অপহরণের রাতে শিশুটিকে জীবিত ঘরে নিয়ে আসে। এরপর আবার তাকে নিয়ে যায়। পরে কী করছে জানি না। এই ঘটনায় যাতে নিজে ফেঁসে যেতে পারেন ভেবে ঘরের পাশের খালে কাদামাটি থেকে শিশুটির মরদেহ কোলে করে নিয়ে পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে তিনি ধরা পড়ে যান।
এদিকে, মার্জিয়ার নানি কুতুবজান বিবি (৮৫)-কে বয়সের বিবেচনায় আটক করে রাখেনি পুলিশ। তাকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির জিম্মায় দিয়ে দেওয়া হয়। পরে গত বৃহস্পতিবার সকালে কানাইঘাট সদর ইউনিয়নের ছাউরা গ্রামে ছোটভাইয়ের বাড়িতে মারা যান তিনি।