Sylhet ০১:৫৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুনামগঞ্জসহ সারাদেশে শিক্ষার্থী উপস্থিতি নগণ্য : রোজায় স্কুল

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শিখন ঘাটতি কমানোর জন্য চলতি রমজানে প্রথম ১০ দিন প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৫ দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় খোলার রাখার নির্দেশ দেয় স্ব স্ব অধিদপ্তর। এই নির্দেশের বিপরীতে সংক্ষুব্ধরা আদালতে পর্যন্ত যান। আদালতও রোজায় স্কুল খোলার রাখার পক্ষে নির্দেশ দেন। কিন্তু এত কিছু করে রোজায় স্কুল খোলা রাখলেও কোনো সুফল ঘরে তোলা যাচ্ছে না। কয়েকটি শহরকেন্দ্রিক স্কুল বাদ দিলে দেশের অধিকাংশ স্কুলেই শিক্ষার্থীর উপস্থিতি খুব সামান্য। কেন শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাচ্ছে না তারও কোনো নজরদারি (মনিটরিং) নেই।
জানতে চাইলে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষার্থীরা স্কুলে না গেলে তো বলা যায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকল। যদি পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকে তাহলে তো সরকার এবং আদালতের নির্দেশও মানা হলো না। এসব দেখার কি কেউ নেই? তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের কাজ কী? যতটুকু জানি তাদের প্রত্যেককে সরকার ভালো ভালো গাড়ি দিয়েছে। গাড়ি চড়ার নাম করেও তো রোজায় স্কুল কেমন চলছে তা দেখে আসা যায়। আসলে কেউ কোনো কাজ করছে না। সবই আল্লাহরওয়াস্তে চলছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ভোরের কাগজকে বলেন, সাপ্তাহিক ছুটি ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে ঘিরে গত শুক্র, শনি ও রবিবার মোট তিন দিনের চিত্র

জানতে পারিনি। গতকাল সোমবার দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কেমন ছিল তা জানাতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন আসার পরে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করব। তিনি বলেন, রোজায়ও শিক্ষা কার্যক্রম জনপ্রিয় করানোর জন্য আমরা একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি এর সুফল দেখতে পাওয়া যাবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান স্কুলে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চললেও গ্রামের স্কুলগুলোতে কিছু প্রভাব পড়েছে। এর দুটি কারণ থাকতে পারে। একটি হচ্ছে- বছরের শুরুর শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। পড়াশুনায় চাপ নেই। ঈদের পরে ভালো করে পড়ব- এমনটি হতে পারে। আরেকটি হচ্ছে- উদ্দেশ্যমূলকভাবেও কেউ সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে না পারে। তবে যেটাই হোক না কেন, আগামী বছর থেকে রোজায় শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে বলে আশাবাদ জানান তিনি। তার মতে, পৃথিবীর বহু দেশে রোজায় স্কুল চালু আছে। বাংলাদেশেও এটা চালু রাখতে হবে। এতে সন্তানদেরই পড়াশোনায় ভালো হবে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে রোজায় স্কুল খোলা থাকলেও কেন শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নেই- এমন প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, বছরের শুরুতে স্কুল ছুটির তালিকায় পুরো রমজান মাসকে ছুটি আওতায় রাখা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ছুটি বাতিল করে বলা হলো, রমজানে স্কুল খোলা থাকবে। এই সিদ্ধান্ত বহু অভিভাবক মানতে পারেননি। তাদের মতে, সিয়াম সাধনার মাসে এ ধরনের সিদ্ধান্ত অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের হতাশ করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে রোজাদার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কষ্টের সম্মুখীন হবেন, আর রোজাদারকে কষ্ট দেয়া চরম অমানবিকতা।
গত বুধবার যশোর ইনস্টিটিউট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দা শিরিন চৌধুরী বলেন, প্রতি রোজায় শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে। এবার তাদের বিদ্যালয়ের ভবন ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশে টিনসেডে ক্লাসে গরম লাগায় শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে গেছে। যশোর টাউন হল মাঠে অভিভাবক আমিনুর রহমান বলেন, রোজার সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকা ভালো। কারণ ছোট ছেলেমেয়েরা প্রথম দিকে রোজা রাখে। ধর্মের ব্যাপার নিষেধ করা কঠিন হয়। ঝিকরগাছার গঙ্গানান্দপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত বিদ্যালয় চলছে। নবম শ্রেণিতে ৭টি এবং অন্যান্য শ্রেণিতে ৬টি করে ক্লাস হচ্ছে। কিন্তু ৩টি ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। রোজায় শিক্ষার্থীদের গড় উপস্থিতি ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে।
চৌগাছার স্বরূপদাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সাহিদুজ্জামান বলেন, ৪র্থ শ্রেণি ও ৫ম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা রোজা রাখে। তারা রোজা রেখে ক্লাসে আসতে চায় না। এলেও সেভাবে মনোযোগ দেয় না। আগে শতভাগ উপস্থিতি থাকলেও এখন উপস্থিতি ২০ ভাগে নেমে এসেছে। যশোর ইসলামিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, রোজা রেখে ৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য কষ্টকর। তাই অনেকে ক্লাসে আসছে না। আমাদেরও ক্লাস নিতে একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে আমার ফোন করে তাদের ক্লাসে আসার জন্য বলছি। আমার চেষ্টায় আছি সবাইকে ক্লাসে আনার এবং ভালোভাবে পাঠদান করানোর। এখানকার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীর সানজানার মা বলেন, ঈদের পরই অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা। ক্লাস না করলেও সমস্যা। আবার রোজা রেখে ক্লাস করা খুবই কষ্টের। দুপুরের পরে মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না।
যশোর সদরের মালঞ্চী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ঝরণা খাতুন বলেন, শিক্ষার্থীদের অনেকেই আসছে না। আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বিদ্যালয়ে আসতে বলছি। যশোর জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সদরের দত্তপাড়া সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুর জব্বার জানান, আমরা সরকারি নির্দেশনা মেনে চলছি। কষ্ট হলেও কিছু করার নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চলতি বছর রমজান মাসজুড়ে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ রাখার দাবিতে বেশ আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি গড়িয়েছে আদালতেও। বর্তমান শিখন কাঠামোতে ১৮৫ দিনের বেশি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার হিসাব ধরে আগামী বছরের শিক্ষাপঞ্জিকা করা হবে। এতে রোজায় ছুটি কমে যাবে। জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, বছরে অন্তত ১৮৫ দিন শিক্ষা কার্যক্রম প্রয়োজন। সে কারণে ছুটি আর বাড়ানোর সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে শিখনঘণ্টা ঠিক রাখতে হবে, আর সে কারণেই আমরা আগামী বছরের শুরুতেই হিসাব-নিকাশ করে শিক্ষাপঞ্জিকা প্রকাশ করব। আগামীতে রমজান মাসজুড়ে ছুটি না দিলে ধর্মীয় কারণে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানে রমজানে ছুটি মাত্র ২ দিন, পাকিস্তানে ৩ দিন। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে রমজান মাসজুড়ে ছুটি নেই। সেসব দেশে রোজার মধ্যে বিদ্যালয় চলতে তো সমস্যা হচ্ছে না। আমাদের কেন হবে? তাছাড়া বাংলাদেশে একসময় শবে কদর থেকে ঈদ পর্যন্ত ছুটি থাকত। তখন তো সমস্যা হয়নি, কেউ আপত্তিও করেনি। তাহলে এখন কেন হবে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, শুধু রাজধানী শহরের বিবেচনায় শিখনঘণ্টা ঠিক থাকবে আর প্রত্যন্ত অঞ্চল বা দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হবে, তা হবে না। সে কারণে ১৮৫ দিনের বেশি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার হিসেব ধরে শিক্ষাপঞ্জিকা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আগামী রমজান মাসে প্রয়োজনে ছুটি কমানো হতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগের কারণে ছুটি দিলে সেখানে শিখনঘণ্টা কমে যায়, বেশি শীত পড়লে ছুটি দিলে শিখনঘণ্টা কমে যায়; এসব কারণে শিখনঘণ্টা হিসাব করে ১৮৫ দিনের বেশি শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষাপঞ্জিকা করা হতে পারে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানের বাইরে তথ্য সংগ্রহসহ নানা কারণে আগের চেয়ে বেশি সময় প্রয়োজন হবে। তাছাড়া সাপ্তাহিক ছুটি একদিন বাড়ানো হয়েছে। শুধু সাপ্তাহিক ছুটিই আছে ১০৪ দিন। ফলে শিখনঘণ্টা ঠিক রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে কমপক্ষে ১৮৫ দিন বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই। শিখনঘণ্টা ঠিক রাখতে বাড়তি দিন হিসেবে ধরে শিক্ষাপঞ্জিকা করার সময় এসেছে।

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জগন্নাথপুর যুব জমিয়তের নবনির্বাচিত কমিটির পরিচিতি শপথ অনুষ্ঠিত

সুনামগঞ্জসহ সারাদেশে শিক্ষার্থী উপস্থিতি নগণ্য : রোজায় স্কুল

প্রকাশের সময় : ১০:১৫:২৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ মার্চ ২০২৪

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শিখন ঘাটতি কমানোর জন্য চলতি রমজানে প্রথম ১০ দিন প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৫ দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় খোলার রাখার নির্দেশ দেয় স্ব স্ব অধিদপ্তর। এই নির্দেশের বিপরীতে সংক্ষুব্ধরা আদালতে পর্যন্ত যান। আদালতও রোজায় স্কুল খোলার রাখার পক্ষে নির্দেশ দেন। কিন্তু এত কিছু করে রোজায় স্কুল খোলা রাখলেও কোনো সুফল ঘরে তোলা যাচ্ছে না। কয়েকটি শহরকেন্দ্রিক স্কুল বাদ দিলে দেশের অধিকাংশ স্কুলেই শিক্ষার্থীর উপস্থিতি খুব সামান্য। কেন শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাচ্ছে না তারও কোনো নজরদারি (মনিটরিং) নেই।
জানতে চাইলে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষার্থীরা স্কুলে না গেলে তো বলা যায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকল। যদি পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকে তাহলে তো সরকার এবং আদালতের নির্দেশও মানা হলো না। এসব দেখার কি কেউ নেই? তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের কাজ কী? যতটুকু জানি তাদের প্রত্যেককে সরকার ভালো ভালো গাড়ি দিয়েছে। গাড়ি চড়ার নাম করেও তো রোজায় স্কুল কেমন চলছে তা দেখে আসা যায়। আসলে কেউ কোনো কাজ করছে না। সবই আল্লাহরওয়াস্তে চলছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ভোরের কাগজকে বলেন, সাপ্তাহিক ছুটি ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে ঘিরে গত শুক্র, শনি ও রবিবার মোট তিন দিনের চিত্র

জানতে পারিনি। গতকাল সোমবার দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কেমন ছিল তা জানাতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন আসার পরে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করব। তিনি বলেন, রোজায়ও শিক্ষা কার্যক্রম জনপ্রিয় করানোর জন্য আমরা একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি এর সুফল দেখতে পাওয়া যাবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান স্কুলে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চললেও গ্রামের স্কুলগুলোতে কিছু প্রভাব পড়েছে। এর দুটি কারণ থাকতে পারে। একটি হচ্ছে- বছরের শুরুর শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। পড়াশুনায় চাপ নেই। ঈদের পরে ভালো করে পড়ব- এমনটি হতে পারে। আরেকটি হচ্ছে- উদ্দেশ্যমূলকভাবেও কেউ সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে না পারে। তবে যেটাই হোক না কেন, আগামী বছর থেকে রোজায় শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে বলে আশাবাদ জানান তিনি। তার মতে, পৃথিবীর বহু দেশে রোজায় স্কুল চালু আছে। বাংলাদেশেও এটা চালু রাখতে হবে। এতে সন্তানদেরই পড়াশোনায় ভালো হবে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে রোজায় স্কুল খোলা থাকলেও কেন শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নেই- এমন প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, বছরের শুরুতে স্কুল ছুটির তালিকায় পুরো রমজান মাসকে ছুটি আওতায় রাখা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ছুটি বাতিল করে বলা হলো, রমজানে স্কুল খোলা থাকবে। এই সিদ্ধান্ত বহু অভিভাবক মানতে পারেননি। তাদের মতে, সিয়াম সাধনার মাসে এ ধরনের সিদ্ধান্ত অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের হতাশ করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে রোজাদার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কষ্টের সম্মুখীন হবেন, আর রোজাদারকে কষ্ট দেয়া চরম অমানবিকতা।
গত বুধবার যশোর ইনস্টিটিউট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দা শিরিন চৌধুরী বলেন, প্রতি রোজায় শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে। এবার তাদের বিদ্যালয়ের ভবন ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশে টিনসেডে ক্লাসে গরম লাগায় শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে গেছে। যশোর টাউন হল মাঠে অভিভাবক আমিনুর রহমান বলেন, রোজার সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকা ভালো। কারণ ছোট ছেলেমেয়েরা প্রথম দিকে রোজা রাখে। ধর্মের ব্যাপার নিষেধ করা কঠিন হয়। ঝিকরগাছার গঙ্গানান্দপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত বিদ্যালয় চলছে। নবম শ্রেণিতে ৭টি এবং অন্যান্য শ্রেণিতে ৬টি করে ক্লাস হচ্ছে। কিন্তু ৩টি ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। রোজায় শিক্ষার্থীদের গড় উপস্থিতি ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে।
চৌগাছার স্বরূপদাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সাহিদুজ্জামান বলেন, ৪র্থ শ্রেণি ও ৫ম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা রোজা রাখে। তারা রোজা রেখে ক্লাসে আসতে চায় না। এলেও সেভাবে মনোযোগ দেয় না। আগে শতভাগ উপস্থিতি থাকলেও এখন উপস্থিতি ২০ ভাগে নেমে এসেছে। যশোর ইসলামিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, রোজা রেখে ৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য কষ্টকর। তাই অনেকে ক্লাসে আসছে না। আমাদেরও ক্লাস নিতে একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে আমার ফোন করে তাদের ক্লাসে আসার জন্য বলছি। আমার চেষ্টায় আছি সবাইকে ক্লাসে আনার এবং ভালোভাবে পাঠদান করানোর। এখানকার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীর সানজানার মা বলেন, ঈদের পরই অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা। ক্লাস না করলেও সমস্যা। আবার রোজা রেখে ক্লাস করা খুবই কষ্টের। দুপুরের পরে মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না।
যশোর সদরের মালঞ্চী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ঝরণা খাতুন বলেন, শিক্ষার্থীদের অনেকেই আসছে না। আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বিদ্যালয়ে আসতে বলছি। যশোর জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সদরের দত্তপাড়া সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুর জব্বার জানান, আমরা সরকারি নির্দেশনা মেনে চলছি। কষ্ট হলেও কিছু করার নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চলতি বছর রমজান মাসজুড়ে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ রাখার দাবিতে বেশ আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি গড়িয়েছে আদালতেও। বর্তমান শিখন কাঠামোতে ১৮৫ দিনের বেশি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার হিসাব ধরে আগামী বছরের শিক্ষাপঞ্জিকা করা হবে। এতে রোজায় ছুটি কমে যাবে। জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, বছরে অন্তত ১৮৫ দিন শিক্ষা কার্যক্রম প্রয়োজন। সে কারণে ছুটি আর বাড়ানোর সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে শিখনঘণ্টা ঠিক রাখতে হবে, আর সে কারণেই আমরা আগামী বছরের শুরুতেই হিসাব-নিকাশ করে শিক্ষাপঞ্জিকা প্রকাশ করব। আগামীতে রমজান মাসজুড়ে ছুটি না দিলে ধর্মীয় কারণে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানে রমজানে ছুটি মাত্র ২ দিন, পাকিস্তানে ৩ দিন। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে রমজান মাসজুড়ে ছুটি নেই। সেসব দেশে রোজার মধ্যে বিদ্যালয় চলতে তো সমস্যা হচ্ছে না। আমাদের কেন হবে? তাছাড়া বাংলাদেশে একসময় শবে কদর থেকে ঈদ পর্যন্ত ছুটি থাকত। তখন তো সমস্যা হয়নি, কেউ আপত্তিও করেনি। তাহলে এখন কেন হবে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, শুধু রাজধানী শহরের বিবেচনায় শিখনঘণ্টা ঠিক থাকবে আর প্রত্যন্ত অঞ্চল বা দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হবে, তা হবে না। সে কারণে ১৮৫ দিনের বেশি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার হিসেব ধরে শিক্ষাপঞ্জিকা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আগামী রমজান মাসে প্রয়োজনে ছুটি কমানো হতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগের কারণে ছুটি দিলে সেখানে শিখনঘণ্টা কমে যায়, বেশি শীত পড়লে ছুটি দিলে শিখনঘণ্টা কমে যায়; এসব কারণে শিখনঘণ্টা হিসাব করে ১৮৫ দিনের বেশি শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষাপঞ্জিকা করা হতে পারে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানের বাইরে তথ্য সংগ্রহসহ নানা কারণে আগের চেয়ে বেশি সময় প্রয়োজন হবে। তাছাড়া সাপ্তাহিক ছুটি একদিন বাড়ানো হয়েছে। শুধু সাপ্তাহিক ছুটিই আছে ১০৪ দিন। ফলে শিখনঘণ্টা ঠিক রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে কমপক্ষে ১৮৫ দিন বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই। শিখনঘণ্টা ঠিক রাখতে বাড়তি দিন হিসেবে ধরে শিক্ষাপঞ্জিকা করার সময় এসেছে।