সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বিপুল সম্পত্তি এখন সরকারের একরকম ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেনজীর পরিবারের শত শত কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। ক্রোক করা সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এখন সরকারের দায়িত্ব।
ইতোমধ্যে গোপালগঞ্জে সাভানা ইকো রিসোর্ট ও ন্যাচারাল পার্ক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে ছয় সদস্যের রিসিভার কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু রিসোর্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে রিসোর্টের বিভিন্ন ধরনের সম্পদ চুরির ঘটনা ঘটেছে। চুরির মামলাও করা হয়েছে দুটি। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কাছে চিঠি দিয়েও সহযোগিতা পাচ্ছে না কমিটি। ফলে বৃহস্পতিবার জরুরি বৈঠকে রিসোর্টের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক ১০ জন আনসার সদস্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে সাভানা ইকো রিসোর্ট রক্ষণাবেক্ষণ কমিটির সদস্য দুদক গোপালগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক মসিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘এত বড় সম্পদ ক্রোক করে তা ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ দুদকের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। তাই শুরুতে হয়তো একটু বেগ পেতে হচ্ছে। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জয়ী হবে দুদক। সে লক্ষ্যেই কাজ চলছে। রিসিভার কমিটি সফলতার সঙ্গে রিসোর্টটি চালু রেখে আয় করা অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা করবে, যা ইতিহাস সৃষ্টি করবে।’
জানা যায়, বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে যেসব সম্পত্তি ঘিরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে, এগুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর অনেক মানুষের রুটি-রুজি নির্ভর করছে। আবার অনেক মূল্যবান সম্পদও রয়েছে। ক্রোক করার পর থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর পড়েছে চোরচক্রের।
তাদের ধারণা, এসব সম্পদ লুট করলে কারও কিছু বলার থাকবে না। এ কারণে সুযোগ বুঝে তারা হামলে পড়ছে। ইতোমধ্যেই গোপালগঞ্জের সাভানা ইকো রিসোর্ট ও ন্যাচারাল পার্কে তিন দফা চুরির ঘটনা ঘটেছে। রিসিভার নিয়োগের আগে প্রথম দফায় চুরি হয়েছে খামারের গরু। এরপর রিসোর্টের ভেতর থাকা বিশাল পুকুরের মাছ ধরে বিক্রি করার সময় দুদক অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাছ জব্দের পর মামলা করেছে। এরপর তৃতীয় দফায় চুরি হয়েছে কম্পিউটার। মাছ ও কম্পিউটার চুরির ঘটনায় পৃথক দুটি করা হয়েছে। কম্পিউটার চুরির মামলার আসামিরা হলেন সজীব মজুমদার, সুরত রায়, অনিমেষ সেন, বিপ্লব ও সঞ্জয় বল।
মামলার বাদী সারোয়ার হোসেন এজাহারে বলেন, ‘রিসোর্টের রিসিভার নিয়োগের পর আমাকে ম্যানেজার (এইচআর) হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১২ জুন রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় আমি আমার অফিসের যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করে শয়নকক্ষে এসে রাতের খাবার শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন ১৩ জুন সকাল ৯টার দিকে প্রতিদিনের মতো পার্কে আমার অফিসে যাই। গিয়ে দেখি আমার অফিস কক্ষ এলোমেলো এবং সেখানে থাকা জিনিসপত্রের মধ্যে ৩টি সিপিইউ ও ১টি মনিটর নেই। পরবর্তী সময়ে আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজন কুমার নন্দীকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অবহিত করি। সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিনজন লোক অফিস কক্ষে ঢুকে কম্পিউটার ও সিপিইউ চুরি করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাভানা ইকো রিসোর্টের ওপর স্থানীয় লোকজনের প্রচণ্ড আক্রোশ কাজ করছে। তাই তারা যে কোনো উপায়ে এ রিসোর্টের কার্যক্রম বন্ধ করতে চায়। রিসোর্টের ভেতর দিয়ে চলাচল করার প্রায় এক কিলোমিটার পাকা সরকারি রাস্তা উদ্ধার করতে চায়। এরই অংশ হিসাবে রিসোর্টে একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটছে। চুরির ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় লোকজনও জড়িত। রিসোর্টের নিরাপত্তা ঘাটতির কথা জানিয়ে ইতোমধ্যে রিসিভার কমিটির তরফ থেকে গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এ অবস্থায় পরিস্থিতি বিবেচনায় বৃহস্পতিবার রিসিভার কমিটির প্রধান গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়। বিকালে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে রিসোর্টের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক ১০ জন আনসার সদস্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া কৃষি ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রুটিনমাফিক সার্বক্ষণিক দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, সাভানা ইকো রিসোর্টে বিপুল ইলেকট্রনিক সামগ্রী, দামি আসবাব ও তৈজসপত্র রয়েছে। এর মধ্যে রিসিপশন কক্ষে আছে নজরকাড়া ৫টি ঝাড়বাতি, একাধিক দামি সোফা সেট, কম্পিউটার, প্রিন্টার, ৭৫ ইঞ্চি এলইডি টিভি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। প্রতিটি তলা আলাদাভাবে সুসজ্জিত। ৭ জুন দুদকের পক্ষ থেকে রিসোর্টের মালামালের একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। রিসোর্টের মানবসম্পদ কর্মকর্তা সারোয়ার হোসেন শাকিল তালিকাটি তৈরি করেন। তাতে দেখা যায়, রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফের দোতলা ভবনের নিচতলায় ৪৭ ধরনের মালামাল রয়েছে। দোতলায় আছে ৪০ ধরনের মালামাল। তৃতীয় তলায় প্রশাসনিক ভবন। সেখানেও বিপুল পরিমাণ মূল্যবান মালামাল রয়েছে।
জানা যায়, বেনজীর পরিবারের অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে খুব বেশি বিচলিত নয় দুদক। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণে তাদের বেশি বেগ পেতে হবে না। তবে স্থাবর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে দুদক হিমশিম খাচ্ছে। এজন্য পর্যায়ক্রমে বেনজীরের বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদের রিসিভার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। সাভানা ইকো রিসোর্টের পর বান্দরবানের খামার, গুলশানের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ অস্থাবর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে রিসিভার নিয়োগ করা হবে।
জানা যায়, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত এত বিপুল সম্পদের তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পরও বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করতে আরও কিছু সময় নিতে চায় দুদক। এ সময়ের মধ্যে বেনজীর পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ, সম্পদবিবরণী নোটিশ জারিসহ বেশকিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানান, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। শিগ্গিরই মামলা করা হবে। সাবেক পুলিশপ্রধানের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ভয়ংকর। দুদক আইন অনুযায়ী যেগুলো অপরাধ ধরা হয়, এর সবই করেছেন বেনজীর।
উল্লেখ্য, ২২ এপ্রিল বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জিসান মির্জা, দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাশিন রাইসা বিনতে বেনজীরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ অনুসন্ধান টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক নিয়ামুল আহসান গাজী ও জয়নাল আবেদীন।
২৬ মে বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা ১১৯টি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন আদালত। এগুলোর মধ্যে রাজধানীর গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট, সাভারের একটি জমি ছাড়াও মাদারীপুরের ১১৪টি দলিলের সম্পত্তি রয়েছে। এর আগে ২৩ মে ৮৩টি দলিলে ক্রয়কৃত সম্পত্তি ক্রোক করা হয়। সেই সঙ্গে ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও তার সিকিউরিটিজের (শেয়ার) টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে।