করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা যখন তুঙ্গে ছিল, তখন এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে চীন যে প্রচেষ্টা শুরু করেছিল, তার বিরুদ্ধে গোপন প্রচারণা শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। ফিলিপাইনে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোই ছিল এর উদ্দেশ্য। সে সময় যেসব দেশে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ শুরু হয়, সেগুলোর মধ্যে ফিলিপাইন একটি। গতকাল শুক্রবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশেষ এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিপিনোদের ছদ্মবেশ ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। অ্যাকাউন্টগুলো থেকে চীনের তৈরি করোনার টিকা সিনোভ্যাক, মাস্ক ও করোনা পরীক্ষার সরঞ্জামের গুণগত মান নিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়। এর সঙ্গে জড়িত ছিল মার্কিন সেনাবাহিনী। যা পরে টিকাবিরোধী অভিযানে পরিণত হয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ কমপক্ষে ৩০০টি ভুয়া অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। যা চীনের টিকা ও অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী সহায়তা সম্পর্কে সাবেক মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের শেয়ার করা বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। প্রায় সবগুলো অ্যাকাউন্ট ২০২০ সালের মাঝামাঝি ‘চীন ইজ দ্য ভাইরাস’ স্লোগানকে কেন্দ্র করে খোলা হয়েছিল। অবশেষে ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রচার প্রচেষ্টা একটি টিকাবিরোধী অভিযানে পরিণত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রচারণার উদ্দেশ্য ছিল চীনের সরবরাহ করা টিকা ও জীবন রক্ষাকারী অন্যান্য উপকরণের সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ ছড়িয়ে দেওয়া। উল্লেখ্য, ফিলিপাইনে করোনার টিকাগুলোর মধ্যে সবার আগে পৌঁছেছিল সিনোভ্যাক। দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই গোপন অপারেশন নিয়ে আগে কোনো ধরনের প্রতিবেদন করা হয়নি।২০২০ সালের জুলাই মাসে এক্স-এ পোস্ট করা হয়েছিল, ‘কভিড এসেছে চীন থেকে এবং ভ্যাকসিনও এসেছে চীন থেকে, চীনকে বিশ্বাস করবেন না!’ সঙ্গে একটি ছবিও ছিল।
ছবিতে চীনা পতাকার পাশে একটি সিরিঞ্জ এবং সংক্রমণের একটি ক্রমবর্ধমান চার্ট ছিল। একই ধরনের আরো একটি পোস্টে লেখা হয়েছিল, ‘চীনের পিপিই, ফেস মাস্ক, ভ্যাকসিন ভুয়া, কিন্তু করোনাভাইরাস আসল।’রয়টার্স এক্স-কে অ্যাকাউন্টগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। এরপর সোশ্যাল মিডিয়া কম্পানিটি প্রোফাইলগুলো সরিয়ে দেয়। এর অর্থ- এটি একটি সমন্বিত প্রচারের অংশ ছিল। মার্কিন সামরিক বাহিনীর ‘অ্যান্টি-ভ্যাক্স’ প্রচেষ্টা ২০২০ সালে শুরু হয়েছিল এবং ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে এটি শেষ হওয়ার আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল।পেন্টাগন এই প্রচারণা মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে স্থানীয় শ্রোতাদের জন্য তৈরি করেছিল এবং একাধিক প্ল্যাটফরমে ভুয়া সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে মুসলমানদের মধ্যে চীনের ভ্যাকসিনের ভয় ছড়িয়ে দিয়েছিল এমন একসময়ে, যখন ভাইরাসটির কারণে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ মারা যাচ্ছিল। কৌশলটির একটি মূল অংশ ছিল, বিতর্ককে আরো ছড়িয়ে দেওয়া। যেহেতু ভ্যাকসিনগুলোতে কখনো কখনো শূকরের মাংসের জেলটিন ব্যবহার করা হয় এবং ইসলামে শূকর নিষিদ্ধ। তাই চীনের এই টিকার ব্যবহার নিষিদ্ধ হতে পারে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে এই সামরিক কর্মসূচি শুরু হয়েছিল এবং জো বাইডেনের সময়কালীনও কয়েক মাস তা অব্যাহত ছিল। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়া নির্বাহীরা নতুন প্রশাসনকে সতর্ক করার পরেও পেন্টাগন কভিড নিয়ে ভুল তথ্য প্রচার করেছে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। পরে হোয়াইট হাউস ২০২১ সালে ‘অ্যান্টি-ভ্যাক্স’ প্রচার প্রচেষ্টা নিষিদ্ধ করে একটি আদেশ জারি করেছিল। এই আদেশ অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীর উৎপাদিত ভ্যাকসিনগুলোকেও প্রভাবিত করেছিল এবং তখন পেন্টাগন একটি অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা শুরু করেছিল।
রয়টার্স জানিয়েছে, ট্রাম্প এবং বাইডেনের মুখপাত্ররা এই গোপন কর্মসূচি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, মার্কিন সামরিক বাহিনী উন্নয়নশীল বিশ্বে চীনের ভ্যাকসিনকে হেয় করার জন্য গোপন প্রচারণা চালিয়েছিল। নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বিস্তারিত আরো কোনো তথ্য জানাননি। তিনি বলেন, এই প্রচারণার লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোর বিরুদ্ধে চীনের যে নেতিবাচক প্রচারণা, তা ঠেকানো। তার দাবি, যুক্তরাষ্ট্র কভিড-১৯ ছড়াচ্ছে বলে একটি প্রচারণা চীনও শুরু করেছিল।
একটি ই-মেইলে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এবং ভুল তথ্য ছড়ায়।
ফিলিপাইনের স্বাস্থ্য বিভাগের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘রয়টার্সের অনুসন্ধানগুলো জড়িত দেশগুলোর যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তদন্ত করা উচিত।’
কিছু আমেরিকান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পেন্টাগনের এমন কর্মকাণ্ডের নিন্দা করে বলেছেন, ‘সম্ভাব্য ভূ-রাজনৈতিক লাভের জন্য বেসামরিক নাগরিকদের বিপদে ফেলেছে তারা।’ ডার্টমাউথ কলেজের গিজেল স্কুল অব মেডিসিনের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল লুসি বলেছেন, ‘মার্কিন সরকার এমনটা করতে পারে, এটা শুনে আমি অত্যন্ত হতাশ, হতাশ এবং হতাশ।’
লুসি এবং অন্যরা বলেছেন, ‘চীনা টিকা সম্পর্কে ভয় জাগানোর প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ভ্যাকসিনসহ সরকারি স্বাস্থ্য উদ্যোগের ওপর সামগ্রিক জনসাধারণের আস্থাকে নষ্ট করে দিয়েছে।’