Sylhet ০২:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গভীর রাতে ছাদ ফুটো করে চার ফাঁসির আসামির পলায়ন, পরে গ্রেপ্তার

  • ভিশন ডেস্ক ::
  • প্রকাশের সময় : ০৬:১৭:২১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০২৪
  • ৪৯

চারজনই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ২৬ দিন ধরে এক সেলেই ছিলেন। সেই কনডেমড সেলে বসেই কারাগারের ছাদ ছিদ্র করে পালানোর পরিকল্পনা করেন। অ্যালুমিনিয়ামের বালতির হাতল দিয়ে দিনের পর দিন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ইট–সুরকির ছাদ ফুটো করেন। ছিদ্রটি গামছা দিয়ে ঢেকে রাখতেন তাঁরা। পরে সুযোগ বুঝে সেই ছিদ্র দিয়ে কারাকক্ষের ছাদে বেরিয়ে আসেন চারজন।

ছাদে যাওয়ার পর কনডেমড সেলের সামনে উন্মুক্ত স্থান পান। সেখানে লোহার খাঁচা পেরিয়েছেন তাঁরা। পরে পেয়েছেন বাইরের উঁচু সীমানা প্রাচীর। বিছানার চাদর, গামছা, লুঙ্গি গিঁট দিয়ে রশির মতো পাকিয়ে সেটি দিয়ে প্রাচীর টপকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। রাত তখন ৩টা ৫ মিনিট।

বগুড়া কারাগার থেকে যেভাবে পালান মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার কয়েদি

গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলায় জেলা কারাগারে এ ঘটনা ঘটে। কারাগারের মূল ফটকের সামনেই করতোয়া নদী। উত্তরে বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পশ্চিমে পুলিশ সুপার ও পৌর কার্যালয়। চার আসামি প্রাচীর টপকে কারাগারের সামনের দিকে চলে আসেন। পরে নদীর তীর ধরে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেননি। আসামি পালানোর বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। পুলিশ শহরজুড়ে সতর্ক পাহারা বসায়। কারাগার থেকে আধা কিলোমিটার দূরে শহরের চেলোপাড়া চাষিবাজারের মাছের আড়ত এলাকা থেকে ভোর সোয়া চারটার দিকে স্থানীয় জনতার হাতে ধরা পড়েন তাঁরা। পরে তাঁদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।

জেলা পুলিশ বলছে, ব্রিটিশ আমলে তৈরি ওই কারাকক্ষের ছাদ তৈরি হয়েছিল ইট, বালু ও চুন–সুরকি দিয়ে। এখানে কোনো রড ছিল না। ফলে জরাজীর্ণ ছাদ ছিদ্র করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁরা।

চার আসামির একজনের বাড়ি কুড়িগ্রাম, একজনের নরসিংদী এবং বাকি দুজন বগুড়ার বাসিন্দা। তাঁদের একজন কাহালু পৌরসভার মেয়র আবদুল মান্নানের ছেলে।

এ ঘটনায় কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জেলা পুলিশ বলছে, ব্রিটিশ আমলে তৈরি ওই কারাকক্ষের ছাদ তৈরি হয়েছিল ইট, বালু ও চুন–সুরকি দিয়ে। এখানে কোনো রড ছিল না। ফলে জরাজীর্ণ ছাদ ছিদ্র করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁরা। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের এমন জরাজীর্ণ সেলে রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি কারাগারের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে আসামিরা কীভাবে পালালেন, তা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা।

গতকাল বগুড়া আসেন কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান। বিকেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, বগুড়ার কারাগারটি অনেক পুরোনো। ১৮৩৩ সালে

পুলিশ বলছে, কারাগারের সব সিসিটিভি ্ক্যামেরা সচল নেই। ৭০০ বন্দী ধারণক্ষমতার কারাগারটিতে তিন গুণের বেশি ২ হাজার ২০০ বন্দী আছেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ওই চার আসামি একটি সেলে গাদাগাদি করে ছিলেন। ওই সেলের ভেতরে কারারক্ষী যাওয়ার সুযোগ ছিল না। কারাকক্ষের যে জায়গায় ছাদে ফুটোটি করা হয়েছে, সেটি ভেতরে না ঢুকলে বোঝার উপায় নেই।

এ ঘটনায় বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী গতকাল সকাল সোয়া ১০টায় নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মাত্র ১৪ মিনিটের মাথায় বুধবার ভোর ৪টা ১০ মিনিটে সদর ফাঁড়ির পুলিশের টহল দল ওই চার কয়েদিকে শহরের চাষিবাজার মাছের আড়ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।

এ ঘটনায় ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

যেভাবে ছাদ ফুটো করা হয়

বগুড়া জেলা কারাগারের জাফলং সেলের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ছাদ ফুটো করতে ৪ দশমিক ১০ ইঞ্চির একটি লোহার পাত ও ৭ ইঞ্চির একটি স্ক্রু ড্রাইভার ব্যবহার করেছিলেন ওই চার আসামি। এ কাজ করতে তাঁরা সময় নিয়েছেন ২০ দিনের বেশি। চারজন মিলে ধীরে ধীরে ছাদের দেয়াল ঘষতে ঘষতে এই ফুটো করেন। সেটি তাঁরা গামছা দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। কারাগার থেকে পালিয়ে গ্রেপ্তারের পর বগুড়া জেলা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন চারজন।

পুলিশ বলছে, আসামিদের কাছ থেকে লোহার পাত ও স্ক্রু ড্রাইভার জব্দ করা হয়েছে। লোহার পাত ও স্ক্রু ড্রাইভার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির কাছে কীভাবে গেল, সেটি এখন তদন্ত করা হচ্ছে বলে জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।

কারাগারের একটি সূত্র জানিয়েছে, জাফলং সেলের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক কারারক্ষীরা থাকেন। আর কারাগারের দেয়ালের বাইরের অংশের নিরাপত্তায় ২৪ ঘণ্টা ১২ জন কারারক্ষী দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে আটজন টহলে থাকেন এবং চারজন কারাগারের বিভিন্ন অংশে নিরাপত্তা বক্সে থেকে দায়িত্ব পালন করেন।

পালাচ্ছিলেন নদীর তীর ধরে

সরেজমিনে দেখা গেছে, বগুড়া কারাগারের মূল ফটক থেকে পূর্ব দিকে ১০০ মিটার সামনে এগোলেই করতোয়া নদী। যে সেল থেকে চার আসামি পালিয়েছেন, সেই সেলের অবস্থান মূল ফটক থেকে ডান দিকে ৫০ মিটারের মধ্যে। এই সেল একেবারে দেয়ালঘেঁষা। নদীর পশ্চিম পাড় ধরে তাঁরা পালাচ্ছিলেন।

চার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত বগুড়া জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কারাগার থেকে পালানোর পর চার আসামি নদীর পাড় ধরে উত্তর দিকে নির্মাণাধীন ফতেহ আলী সেতুর দিকে এগিয়ে যান। আসামিরা পালিয়েছেন ৩টা ৫ মিনিটে। কারা কর্তৃপক্ষ সে তথ্য পুলিশকে জানিয়েছে রাত ৩টা ৫৬ মিনিটে। খবর পাওয়ার ১৪ মিনিট পরই তাঁরা ধরা পড়েন।

বগুড়া পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র দাস জানিয়েছেন, চাষিবাজারের কাছে করতোয়া নদীর ওপর নির্মাণাধীন ফতেহ আলী সেতুর কাছ থেকে ভোর পৌনে চারটার দিকে সন্দেহভাজন চারজনকে আটক করেন স্থানীয় কয়কজন যুবক। তাঁরা ফতেহ আলী সেতুর কাছাকাছি রেলসেতুতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। তখন সেতুর কাছে কয়েকটি কুকুর হঠাৎ ঘেউ ঘেউ শুরু করে। যুবকেরা সেখানে এসে চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। এ সময় চারজন নিজেদের রাজমিস্ত্রি পরিচয় দেন। তাঁরা জানান, মালিক তাঁদের মারধর করেছেন, এ জন্য রাতে পালিয়ে এসেছেন। তাঁদের কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে না হওয়ায় যুবকেরা তাঁকে (কাউন্সিলর পরিমল) ফোন করে বিষয়টি জানান। তখন পরিমল চারজনকে পুলিশে দিতে বলেন।

কারাগারের ছাদ ফুটো করে আসামি পালানোর ঘটনায় গতকাল বগুড়া জেলা কারাগারের জেলার মো. ফরিদুর রহমান বাদী হয়ে সদর থানায় একটি মামলা করেন। এজাহারে উল্লেখ করা চার কয়েদি হলেন কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গা এলাকার নজরুল ইসলাম ওরফে মজনু (বয়স ৬৮, কয়েদি নম্বর ৯৯৮), নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার ফজরকান্দি এলাকার আমির হোসেন (বয়স ৪১, কয়েদি নম্বর ৫১০৫), বগুড়ার কাহালু পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল মান্নানের ছেলে মো. জাকারিয়া (বয়স ৩৪, কয়েদি নম্বর ৩৬৮৫) এবং বগুড়ার কুটুরবাড়ি পশ্চিম পাড়া এলাকার ফরিদ শেখ (বয়স ৩০, কয়েদি নম্বর ৪২৫২)।

চার আসামির এক কক্ষে থাকা প্রসঙ্গে বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জাকারিয়াসহ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামিকে ১ জুন থেকে বগুড়া কারাগারের কনডেমড সেলে একসঙ্গে রাখা হয়। ২ জুন কারাগার পরিদর্শনকালে কনডেমড সেলে তাদের একসঙ্গে দেখতে পাই। তারা মাত্র ২৫ দিনেই ওই সেল থেকে পালানোর পরিকল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়ন করে।’

থানা–পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কাহালু উপজেলায় স্কুলছাত্র নাইমুল ইসলাম ওরফে নাইমকে (১৩) অপহরণের পর হত্যা এবং ইটভাটায় লাশ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করার দায়ে মো. জাকারিয়ার মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রায় ঘোষণার পর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন। গত বছরের ৬ জুলাই উপজেলার উলট্ট বাজার থেকে জাকারিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

কয়েদি ফরিদ শেখের বাড়ি বগুড়া সদর উপজেলার কুটুরবাড়ি এলাকায়। জমিজমা নিয়ে এলাকার ইয়াকুব আলী শেখের সঙ্গে ফরিদ শেখের পরিবারের বিরোধ ছিল। এর জের ধরে ২০১৯ সালের ৬ জুন দুই পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে আল আমিন (১৮) নামের এক তরুণকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর পেটে আঘাত করেন ফরিদ শেখ। পরে আল আমিন মারা যান। ওই ঘটনায় করা মামলায় ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর ফরিদ শেখকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।

নজরুল ইসলামের বাড়ি কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গা এলাকায় এবং আমির হোসেনের বাড়ি নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার ফজরকান্দি এলাকায়। ২০১৪ সালে ভূরুঙ্গামারীর সীমান্তবর্তী দিয়াডাঙ্গা গ্রামে ডাকাতি ও চার খুনের মামলায় তাঁরা দুজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৪ জানুয়ারি রাতে দিয়াডাঙ্গা গ্রামের সুলতান আহমেদের বাড়িতে ডাকাতি হয়। এ সময় ডাকাত দল সুলতান মণ্ডল, তাঁর স্ত্রী হাজেরা বেগম, তাঁদের দুই নাতনি রোমানা ও আনিকাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।

#প্রথম আলো

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Sylhet Vision

বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের মামলায় জামিন পেলেন সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান

গভীর রাতে ছাদ ফুটো করে চার ফাঁসির আসামির পলায়ন, পরে গ্রেপ্তার

প্রকাশের সময় : ০৬:১৭:২১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০২৪

চারজনই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ২৬ দিন ধরে এক সেলেই ছিলেন। সেই কনডেমড সেলে বসেই কারাগারের ছাদ ছিদ্র করে পালানোর পরিকল্পনা করেন। অ্যালুমিনিয়ামের বালতির হাতল দিয়ে দিনের পর দিন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ইট–সুরকির ছাদ ফুটো করেন। ছিদ্রটি গামছা দিয়ে ঢেকে রাখতেন তাঁরা। পরে সুযোগ বুঝে সেই ছিদ্র দিয়ে কারাকক্ষের ছাদে বেরিয়ে আসেন চারজন।

ছাদে যাওয়ার পর কনডেমড সেলের সামনে উন্মুক্ত স্থান পান। সেখানে লোহার খাঁচা পেরিয়েছেন তাঁরা। পরে পেয়েছেন বাইরের উঁচু সীমানা প্রাচীর। বিছানার চাদর, গামছা, লুঙ্গি গিঁট দিয়ে রশির মতো পাকিয়ে সেটি দিয়ে প্রাচীর টপকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। রাত তখন ৩টা ৫ মিনিট।

বগুড়া কারাগার থেকে যেভাবে পালান মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার কয়েদি

গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলায় জেলা কারাগারে এ ঘটনা ঘটে। কারাগারের মূল ফটকের সামনেই করতোয়া নদী। উত্তরে বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পশ্চিমে পুলিশ সুপার ও পৌর কার্যালয়। চার আসামি প্রাচীর টপকে কারাগারের সামনের দিকে চলে আসেন। পরে নদীর তীর ধরে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেননি। আসামি পালানোর বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। পুলিশ শহরজুড়ে সতর্ক পাহারা বসায়। কারাগার থেকে আধা কিলোমিটার দূরে শহরের চেলোপাড়া চাষিবাজারের মাছের আড়ত এলাকা থেকে ভোর সোয়া চারটার দিকে স্থানীয় জনতার হাতে ধরা পড়েন তাঁরা। পরে তাঁদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।

জেলা পুলিশ বলছে, ব্রিটিশ আমলে তৈরি ওই কারাকক্ষের ছাদ তৈরি হয়েছিল ইট, বালু ও চুন–সুরকি দিয়ে। এখানে কোনো রড ছিল না। ফলে জরাজীর্ণ ছাদ ছিদ্র করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁরা।

চার আসামির একজনের বাড়ি কুড়িগ্রাম, একজনের নরসিংদী এবং বাকি দুজন বগুড়ার বাসিন্দা। তাঁদের একজন কাহালু পৌরসভার মেয়র আবদুল মান্নানের ছেলে।

এ ঘটনায় কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জেলা পুলিশ বলছে, ব্রিটিশ আমলে তৈরি ওই কারাকক্ষের ছাদ তৈরি হয়েছিল ইট, বালু ও চুন–সুরকি দিয়ে। এখানে কোনো রড ছিল না। ফলে জরাজীর্ণ ছাদ ছিদ্র করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁরা। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের এমন জরাজীর্ণ সেলে রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি কারাগারের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে আসামিরা কীভাবে পালালেন, তা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা।

গতকাল বগুড়া আসেন কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান। বিকেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, বগুড়ার কারাগারটি অনেক পুরোনো। ১৮৩৩ সালে

পুলিশ বলছে, কারাগারের সব সিসিটিভি ্ক্যামেরা সচল নেই। ৭০০ বন্দী ধারণক্ষমতার কারাগারটিতে তিন গুণের বেশি ২ হাজার ২০০ বন্দী আছেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ওই চার আসামি একটি সেলে গাদাগাদি করে ছিলেন। ওই সেলের ভেতরে কারারক্ষী যাওয়ার সুযোগ ছিল না। কারাকক্ষের যে জায়গায় ছাদে ফুটোটি করা হয়েছে, সেটি ভেতরে না ঢুকলে বোঝার উপায় নেই।

এ ঘটনায় বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী গতকাল সকাল সোয়া ১০টায় নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মাত্র ১৪ মিনিটের মাথায় বুধবার ভোর ৪টা ১০ মিনিটে সদর ফাঁড়ির পুলিশের টহল দল ওই চার কয়েদিকে শহরের চাষিবাজার মাছের আড়ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।

এ ঘটনায় ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

যেভাবে ছাদ ফুটো করা হয়

বগুড়া জেলা কারাগারের জাফলং সেলের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ছাদ ফুটো করতে ৪ দশমিক ১০ ইঞ্চির একটি লোহার পাত ও ৭ ইঞ্চির একটি স্ক্রু ড্রাইভার ব্যবহার করেছিলেন ওই চার আসামি। এ কাজ করতে তাঁরা সময় নিয়েছেন ২০ দিনের বেশি। চারজন মিলে ধীরে ধীরে ছাদের দেয়াল ঘষতে ঘষতে এই ফুটো করেন। সেটি তাঁরা গামছা দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। কারাগার থেকে পালিয়ে গ্রেপ্তারের পর বগুড়া জেলা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন চারজন।

পুলিশ বলছে, আসামিদের কাছ থেকে লোহার পাত ও স্ক্রু ড্রাইভার জব্দ করা হয়েছে। লোহার পাত ও স্ক্রু ড্রাইভার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির কাছে কীভাবে গেল, সেটি এখন তদন্ত করা হচ্ছে বলে জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।

কারাগারের একটি সূত্র জানিয়েছে, জাফলং সেলের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক কারারক্ষীরা থাকেন। আর কারাগারের দেয়ালের বাইরের অংশের নিরাপত্তায় ২৪ ঘণ্টা ১২ জন কারারক্ষী দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে আটজন টহলে থাকেন এবং চারজন কারাগারের বিভিন্ন অংশে নিরাপত্তা বক্সে থেকে দায়িত্ব পালন করেন।

পালাচ্ছিলেন নদীর তীর ধরে

সরেজমিনে দেখা গেছে, বগুড়া কারাগারের মূল ফটক থেকে পূর্ব দিকে ১০০ মিটার সামনে এগোলেই করতোয়া নদী। যে সেল থেকে চার আসামি পালিয়েছেন, সেই সেলের অবস্থান মূল ফটক থেকে ডান দিকে ৫০ মিটারের মধ্যে। এই সেল একেবারে দেয়ালঘেঁষা। নদীর পশ্চিম পাড় ধরে তাঁরা পালাচ্ছিলেন।

চার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত বগুড়া জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কারাগার থেকে পালানোর পর চার আসামি নদীর পাড় ধরে উত্তর দিকে নির্মাণাধীন ফতেহ আলী সেতুর দিকে এগিয়ে যান। আসামিরা পালিয়েছেন ৩টা ৫ মিনিটে। কারা কর্তৃপক্ষ সে তথ্য পুলিশকে জানিয়েছে রাত ৩টা ৫৬ মিনিটে। খবর পাওয়ার ১৪ মিনিট পরই তাঁরা ধরা পড়েন।

বগুড়া পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র দাস জানিয়েছেন, চাষিবাজারের কাছে করতোয়া নদীর ওপর নির্মাণাধীন ফতেহ আলী সেতুর কাছ থেকে ভোর পৌনে চারটার দিকে সন্দেহভাজন চারজনকে আটক করেন স্থানীয় কয়কজন যুবক। তাঁরা ফতেহ আলী সেতুর কাছাকাছি রেলসেতুতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। তখন সেতুর কাছে কয়েকটি কুকুর হঠাৎ ঘেউ ঘেউ শুরু করে। যুবকেরা সেখানে এসে চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। এ সময় চারজন নিজেদের রাজমিস্ত্রি পরিচয় দেন। তাঁরা জানান, মালিক তাঁদের মারধর করেছেন, এ জন্য রাতে পালিয়ে এসেছেন। তাঁদের কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে না হওয়ায় যুবকেরা তাঁকে (কাউন্সিলর পরিমল) ফোন করে বিষয়টি জানান। তখন পরিমল চারজনকে পুলিশে দিতে বলেন।

কারাগারের ছাদ ফুটো করে আসামি পালানোর ঘটনায় গতকাল বগুড়া জেলা কারাগারের জেলার মো. ফরিদুর রহমান বাদী হয়ে সদর থানায় একটি মামলা করেন। এজাহারে উল্লেখ করা চার কয়েদি হলেন কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গা এলাকার নজরুল ইসলাম ওরফে মজনু (বয়স ৬৮, কয়েদি নম্বর ৯৯৮), নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার ফজরকান্দি এলাকার আমির হোসেন (বয়স ৪১, কয়েদি নম্বর ৫১০৫), বগুড়ার কাহালু পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল মান্নানের ছেলে মো. জাকারিয়া (বয়স ৩৪, কয়েদি নম্বর ৩৬৮৫) এবং বগুড়ার কুটুরবাড়ি পশ্চিম পাড়া এলাকার ফরিদ শেখ (বয়স ৩০, কয়েদি নম্বর ৪২৫২)।

চার আসামির এক কক্ষে থাকা প্রসঙ্গে বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জাকারিয়াসহ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামিকে ১ জুন থেকে বগুড়া কারাগারের কনডেমড সেলে একসঙ্গে রাখা হয়। ২ জুন কারাগার পরিদর্শনকালে কনডেমড সেলে তাদের একসঙ্গে দেখতে পাই। তারা মাত্র ২৫ দিনেই ওই সেল থেকে পালানোর পরিকল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়ন করে।’

থানা–পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কাহালু উপজেলায় স্কুলছাত্র নাইমুল ইসলাম ওরফে নাইমকে (১৩) অপহরণের পর হত্যা এবং ইটভাটায় লাশ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করার দায়ে মো. জাকারিয়ার মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রায় ঘোষণার পর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন। গত বছরের ৬ জুলাই উপজেলার উলট্ট বাজার থেকে জাকারিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

কয়েদি ফরিদ শেখের বাড়ি বগুড়া সদর উপজেলার কুটুরবাড়ি এলাকায়। জমিজমা নিয়ে এলাকার ইয়াকুব আলী শেখের সঙ্গে ফরিদ শেখের পরিবারের বিরোধ ছিল। এর জের ধরে ২০১৯ সালের ৬ জুন দুই পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে আল আমিন (১৮) নামের এক তরুণকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর পেটে আঘাত করেন ফরিদ শেখ। পরে আল আমিন মারা যান। ওই ঘটনায় করা মামলায় ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর ফরিদ শেখকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।

নজরুল ইসলামের বাড়ি কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গা এলাকায় এবং আমির হোসেনের বাড়ি নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার ফজরকান্দি এলাকায়। ২০১৪ সালে ভূরুঙ্গামারীর সীমান্তবর্তী দিয়াডাঙ্গা গ্রামে ডাকাতি ও চার খুনের মামলায় তাঁরা দুজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৪ জানুয়ারি রাতে দিয়াডাঙ্গা গ্রামের সুলতান আহমেদের বাড়িতে ডাকাতি হয়। এ সময় ডাকাত দল সুলতান মণ্ডল, তাঁর স্ত্রী হাজেরা বেগম, তাঁদের দুই নাতনি রোমানা ও আনিকাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।

#প্রথম আলো