Sylhet ০১:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আজ বঙ্গবন্ধুর ১০৪তম জন্মদিন

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ তিনি এই বাক্যবন্ধে কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলেননি। মানুষের ওপর মানুষের সব ধরনের শোষণ–বঞ্চনা ও অধীনতার অবসানের কথাও উচ্চারণ করেছেন।

‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ কথাটিতে কেবল একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্পৃহা প্রকাশিত হয় না। তাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্ম–অহংকারেরও প্রতিধ্বনি ঘটে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে ধর্মঘট হয়, তা সংগঠিত করতে গিয়ে অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে শেখ মুজিবও গ্রেপ্তার হন।

এ দেশে বঙ্গবন্ধুর আগেও অনেক নেতা বিক্ষিপ্তভাবে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। দেশভাগের প্রাক্কালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। চুয়ান্নর নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ঘোষণা দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক সীমানা দিয়ে বাঙালিকে বিভক্ত করা যাবে না। সাতান্ন সালেই মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানিদের প্রতি ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেছিলেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মানুষকে আন্দোলনের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে চূড়ান্ত মুহূর্তে ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাংলাদেশের মানুষও তখন স্বাধীনতার বিকল্প কিছু চিন্তা করেনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনীতির শুরু গেল শতকের চল্লিশের দশকে, মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে। এরপর তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য হিসেবে যুক্তবঙ্গ আন্দোলনে যুক্ত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে ধর্মঘট হয়, তা সংগঠিত করতে গিয়ে অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে শেখ মুজিবও গ্রেপ্তার হন।

এরপর কারাগার হয়ে ওঠে তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের মধ্যে ১২ বছরের বেশি সময় তিনি বন্দিজীবন কাটান।

পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে শেখ মুজিব যেসব বক্তৃতা–বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে বাঙালির স্বশাসন ও স্বাধিকার আদায়ের কথাই বেশি উচ্চারিত হয়েছে।

এরপর কারাগার হয়ে ওঠে তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের মধ্যে ১২ বছরের বেশি সময় তিনি বন্দিজীবন কাটান।

শেখ মুজিব ছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা। তারপরও তিনি সশস্ত্র পথে যে স্বাধীনতার কথা ভেবেছেন, ১৯৬২ সালে গোপনে আগরতলা যাত্রাই তার প্রমাণ।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে বাঙালি তার মধ্যে আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। অন্যদিকে পাকিস্তানিরা ভাবে এটা ছিল বিচ্ছিন্নতার কৌশল। বিরোধী দলের বৈঠকে তারা ছয় দফা উপস্থাপন করতে দেয়নি। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ঠেকাতে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেন, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে অধিক পরিচিত।

তাঁর ধারণা ছিল ভারতকে জড়িয়ে কোনো মামলা হলে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে; কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টো। আগরতলা মামলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণ-আন্দোলন গণ–অভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। শেখ মুজিব কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন জননন্দিত নেতা হিসেবে।

১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ঠেকাতে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেন, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে অধিক পরিচিত।

সত্তরের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। এরপরই পাকিস্তানি সামরিক চক্র ও সংখ্যালঘিষ্ঠ দল পিপিপির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো চক্রান্ত আঁটেন, যাতে কোনোভাবে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলে ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশ হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। চলে সর্বাত্মক অসহযোগ।

এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে হয় চিন্তাভাবনা করে। তিনি যেমন জনগণের তুঙ্গে ওঠা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে রাশ টানতে চাননি, তেমনি এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি, যাতে পাকিস্তানিরা তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে সামরিক অভিযান চালানোর সুযোগ পায়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি তাঁর বার্তা সেটা পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, জনগণ তাঁর সঙ্গে আছে, পাকিস্তানিরা যতই শক্তি প্রয়োগ করুক, সফল হবে না। সাত কোটি মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যখন আলোচনা ভেঙে গেল, তিনি সহকর্মীদের নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও নিজে থেকে যান ৩২ নম্বরেই। স্বাধীনতার জন্য তিনি নিজের জীবনকেই জিম্মি করলেন।

পাকিস্তানিরা তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে সামরিক অভিযান চালানোর সুযোগ পায়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি তাঁর বার্তা সেটা পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন।

২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে অধ্যাপক রেহমান সোবহান পাকিস্তান টাইমস–এর সাবেক সম্পাদক মাজহার আলী খানকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। মাজহার আলী খান সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইয়াহিয়া ভেবেছেন, আমাকে হত্যা করলেই আন্দোলন দমন করা যাবে। কিন্তু তাঁর মনে রাখা উচিত আমার কবরের ওপর হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।’

১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলেও স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পর এদেশীয় ঘাতকদের হাতেই তাঁকে জীবন দিতে হয়। এটা কেবল ব্যক্তি নয়, পুরো জাতির জন্য ভয়ংকর ট্র্যাজেডি।

ইয়াহিয়া ভেবেছেন, আমাকে হত্যা করলেই আন্দোলন দমন করা যাবে। কিন্তু তাঁর মনে রাখা উচিত আমার কবরের ওপর হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।

মাজহার আলী খান

জীবিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান চরিত্র ছিলেন, মৃত্যুর পরও।

শামসুর রাহমানের কবিতার পঙ্‌ক্তি দিয়ে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাই:

ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে চিরকাল,

গান হয়ে

নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা, যাঁর নামের ওপর

কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া,

ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পাখা মেলে দেয় জ্যোৎস্নার সারস,

ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পতাকার মতো

দুলতে থাকে স্বাধীনতা,

ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর ঝরে

মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

আজ বঙ্গবন্ধুর ১০৪তম জন্মদিন

প্রকাশের সময় : ০৪:৫২:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ মার্চ ২০২৪

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ তিনি এই বাক্যবন্ধে কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলেননি। মানুষের ওপর মানুষের সব ধরনের শোষণ–বঞ্চনা ও অধীনতার অবসানের কথাও উচ্চারণ করেছেন।

‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ কথাটিতে কেবল একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্পৃহা প্রকাশিত হয় না। তাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্ম–অহংকারেরও প্রতিধ্বনি ঘটে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে ধর্মঘট হয়, তা সংগঠিত করতে গিয়ে অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে শেখ মুজিবও গ্রেপ্তার হন।

এ দেশে বঙ্গবন্ধুর আগেও অনেক নেতা বিক্ষিপ্তভাবে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। দেশভাগের প্রাক্কালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। চুয়ান্নর নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ঘোষণা দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক সীমানা দিয়ে বাঙালিকে বিভক্ত করা যাবে না। সাতান্ন সালেই মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানিদের প্রতি ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেছিলেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মানুষকে আন্দোলনের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে চূড়ান্ত মুহূর্তে ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাংলাদেশের মানুষও তখন স্বাধীনতার বিকল্প কিছু চিন্তা করেনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনীতির শুরু গেল শতকের চল্লিশের দশকে, মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে। এরপর তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য হিসেবে যুক্তবঙ্গ আন্দোলনে যুক্ত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে ধর্মঘট হয়, তা সংগঠিত করতে গিয়ে অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে শেখ মুজিবও গ্রেপ্তার হন।

এরপর কারাগার হয়ে ওঠে তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের মধ্যে ১২ বছরের বেশি সময় তিনি বন্দিজীবন কাটান।

পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে শেখ মুজিব যেসব বক্তৃতা–বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে বাঙালির স্বশাসন ও স্বাধিকার আদায়ের কথাই বেশি উচ্চারিত হয়েছে।

এরপর কারাগার হয়ে ওঠে তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের মধ্যে ১২ বছরের বেশি সময় তিনি বন্দিজীবন কাটান।

শেখ মুজিব ছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা। তারপরও তিনি সশস্ত্র পথে যে স্বাধীনতার কথা ভেবেছেন, ১৯৬২ সালে গোপনে আগরতলা যাত্রাই তার প্রমাণ।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে বাঙালি তার মধ্যে আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। অন্যদিকে পাকিস্তানিরা ভাবে এটা ছিল বিচ্ছিন্নতার কৌশল। বিরোধী দলের বৈঠকে তারা ছয় দফা উপস্থাপন করতে দেয়নি। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ঠেকাতে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেন, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে অধিক পরিচিত।

তাঁর ধারণা ছিল ভারতকে জড়িয়ে কোনো মামলা হলে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে; কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টো। আগরতলা মামলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণ-আন্দোলন গণ–অভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। শেখ মুজিব কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন জননন্দিত নেতা হিসেবে।

১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ঠেকাতে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেন, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে অধিক পরিচিত।

সত্তরের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। এরপরই পাকিস্তানি সামরিক চক্র ও সংখ্যালঘিষ্ঠ দল পিপিপির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো চক্রান্ত আঁটেন, যাতে কোনোভাবে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলে ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশ হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। চলে সর্বাত্মক অসহযোগ।

এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে হয় চিন্তাভাবনা করে। তিনি যেমন জনগণের তুঙ্গে ওঠা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে রাশ টানতে চাননি, তেমনি এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি, যাতে পাকিস্তানিরা তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে সামরিক অভিযান চালানোর সুযোগ পায়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি তাঁর বার্তা সেটা পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, জনগণ তাঁর সঙ্গে আছে, পাকিস্তানিরা যতই শক্তি প্রয়োগ করুক, সফল হবে না। সাত কোটি মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যখন আলোচনা ভেঙে গেল, তিনি সহকর্মীদের নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও নিজে থেকে যান ৩২ নম্বরেই। স্বাধীনতার জন্য তিনি নিজের জীবনকেই জিম্মি করলেন।

পাকিস্তানিরা তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে সামরিক অভিযান চালানোর সুযোগ পায়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি তাঁর বার্তা সেটা পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন।

২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে অধ্যাপক রেহমান সোবহান পাকিস্তান টাইমস–এর সাবেক সম্পাদক মাজহার আলী খানকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। মাজহার আলী খান সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইয়াহিয়া ভেবেছেন, আমাকে হত্যা করলেই আন্দোলন দমন করা যাবে। কিন্তু তাঁর মনে রাখা উচিত আমার কবরের ওপর হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।’

১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলেও স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পর এদেশীয় ঘাতকদের হাতেই তাঁকে জীবন দিতে হয়। এটা কেবল ব্যক্তি নয়, পুরো জাতির জন্য ভয়ংকর ট্র্যাজেডি।

ইয়াহিয়া ভেবেছেন, আমাকে হত্যা করলেই আন্দোলন দমন করা যাবে। কিন্তু তাঁর মনে রাখা উচিত আমার কবরের ওপর হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।

মাজহার আলী খান

জীবিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান চরিত্র ছিলেন, মৃত্যুর পরও।

শামসুর রাহমানের কবিতার পঙ্‌ক্তি দিয়ে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাই:

ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে চিরকাল,

গান হয়ে

নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা, যাঁর নামের ওপর

কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া,

ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পাখা মেলে দেয় জ্যোৎস্নার সারস,

ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পতাকার মতো

দুলতে থাকে স্বাধীনতা,

ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর ঝরে

মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।